হাঁসেদের ডানায় আসে জিবরাইল
রাজিয়া সুলতানা নুরিন
সহজ কথার সময়কাল বোধহয় শেষ কিংবা জনমানুষ থেকে দূরে থাকা কোনো শব্দ আবিষ্কার
করে ফেলেছি। এই একটা জীবনেই এক যুগ গেল- কেউ যদি একটু বুঝে নিত কত সহজ হয়ে যেত
বেঁচে থাকা। এখন খুব হিংস্র লাগে বুঝতে পারা প্রতিটা চোখকে। জনমানুষের শব্দ এবং জীবন
দুইটাই মন থেকে ঘৃণা করি। আমি ভুলে গেছি নিয়মনীতির যোগফল। সকল প্রকার
ভালোবাসাকেই শেকড় মনে হয়। মনে হয় এরিকফ্রম আমার ব্যক্তিগত সমস্যাকেই
বলে গেছে। নিজেকে মনে হয় এক অখণ্ড অভিধান। আমাকে বোঝার কিছু নেই। আপনাকে বুঝতে
আপনার যত সীমাবদ্ধতা সেসব বুঝতে আমাকে পড়ুন। আমি মাথা উঁচু করে হাঁটতে হাঁটতে
অদেখা করে গেছি প্রতিটা পোকাজীবন,অথচ পাখিদের পোকা খাওয়া কত সহজ সমীকরণ। মাথা
একটা উম্মাদ পাগলাগারদ, সব কথা সব অনুভূতির গোড়া ঘষতে ঘষতে হারায়ে ফেলেছি কিংবা
কদম গাছে ফোঁটাচ্ছি বটফুল। ভাঁটফুল খেলে মানুষ মরে যায়।কিহ সুন্দর মৃত্যু হে খোদা;ফুল
খেয়ে মরে গেছে হোসনেয়ারা।
পর্যাপ্ত ঘুম অর্থ এবং খাদ্য মানুষের জীবনকে কমলা রং করে দেয়। কমলা রঙের একটা প্রিয় ফ্রগ
ছিল আমার। ছোটবেলায় বকুলের রঙে নষ্ট হয়ে গেছে। যুগ যুগ একই দৃশ্যের কাছে হাটু গেড়ে
বসতে বসতে এখন নিঃশ্বাসকেই ইবাদত মনে হয়। মনে হয় লিখতে বসলেই লিখে ফেলবো সব
সত্যি কথা, সত্যি বলতে যেসব মিথ্যে কথার উপর দুলছে জীবন সেসব কথা, ছলনার কথা,
তোমার আমার কথা। মৃত্যুর সৌন্দর্যতা কল্পনা করতে করতে ভুলে যাই বেঁচে থাকা ঈশ্বরের কথা।
পৃথিবীতে এখন ঠিক কতজন দেবতা বেঁচে আছেন? তারাও কি রোজ অফিস করছে, চুমু খাচ্ছে,
সঠিক সময় বাড়ি ফিরছে? ভুল উচ্চারণে কবিতা পড়ছে? দুইফিতার জুতা খুলে তারাও কি রোজ
করতেছে পৃথিবীতে টাকা কামানোর পথঘাটের খোঁজ। নাকি কীটদের দলে? কীটেদের জীবনবীমা
রক্ষার মিছিল থামছে না মাটি থাকা অব্দি। বাতাস ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে প্রেমিকার ঠোঁটে। অঢেল
কথাবলার মধ্যে মরে গেছে গাছ, পাখির ঘরহীনতা কালো করে দিয়েছে আকাশ।
চোখ ভেঙ্গে খুলে আসছে চশমায়। বিড়ালের বিষন্নতাকে লাথি মেরে সকাল হয়ে গেছে দুপুর।
দিশেহারা শেয়াল এখনো ডেকে যাচ্ছে বন্ধ চোখে। মোটর ভর্তি চুইয়ে পড়ে যাচ্ছে জীবনের অপর
নাম -পানি। দৃষ্টির সীমানা এড়িয়ে যাচ্ছে হাসিখুশি সংসার। সব কথা ঢেকে গেছে শব্দে, আওয়াজে
অথচ শোনা গেল না কিছুই। বুকে বন্দুক ধরে গুলি করে দিতে হবে প্রতিটা বোকা মানুষের, যাতে
করে কেউ কেউ বলে উঠতে না পারে- বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বেঁচে থাকা দীর্ঘজীবী হোক। আমি
মৃত্যুর জন্য বাঁচিয়ে রাখিনি কোনো কাজ, সব লেখা হয়ে গেছে কেবল প্রুফ রিডিং বাকি। তাক
করে রাখা বন্দুকের একটা গুলি বের হওয়া বাকি। বেঁচে থাকার একশ একটা উপায় লিখতে
লিখতে ক্লান্ত লাগে রাসূল। হাতের তালুর মতো বদলে যাচ্ছে রেখা। ভুল বানানের লাল কালিতে
আগুন ধরে গেছে। যতক্ষণ চোখ খোলা ততক্ষণ কলম চলতে পারে ঠিকই কিন্তু ট্রেন ছেড়ে গেছে
স্টেশন। শাঁকের শব্দ ছিড়ে ফেলেছে কান। ঘুমাতে দাও নাবিক, তীরে নেই কোনো অবশিষ্ট শান্তি।
শেষমেষে না গেলে সমাধানে যাওয়া যায় না বলে প্রচলিত কথা আমি অবিশ্বাস করি। কবি মরে গেলে
অপ্রকাশিত কবিতা ছাপানো কে দোষ নয় বরং অক্ষমতাই বলে মনে হয়। শিশুর সহজ
নামতা পড়ার সুর পৃথিবীর যেকোনো শহরের জন্য আগামীর বার্তা। মাথার ভেতরের দৌড়
কলমের ভেতরেও ছুটে চলছে। অনর্গল ভুল বানানে ভরে উঠেছে দলিল পত্র। আমাদের শিশুরা
চকলেট থেকে একসময় বাড়ি ভাগও শিখে যাবে নিশ্চিত। একটা গ্রাম ঘুমিয়ে গেলে নতুন বাচ্চার
কান্না ভূতের ভয়ের আওয়াজের মতনই লাগে। পুরনো বই ফেলে ছেলে বিদেশে, মা জানেন না
সেইসব বইয়ের ভেতর একদিন কত প্রেম আসা-যাওয়া করতো। এখন পৃষ্ঠা বলতে সেসব কেবল
টাকাই। মফঃস্বলের ছাদের উপর চাঁদ অন্যরকম এক নান্দনিক চেহারা। ওপাড়ে মসজিদের
আজান, নদীতে ট্রলারের শব্দ এক মহাজাগতিক সিনেমা। যেন বেহুলা লক্ষিন্দরের আগমনী
পরিবেশ। উপরে দেখলেই মনে হয় এক বিশেষ আয়োজন চলছে। দেবতার যুদ্ধ বিদ্যমান। হেরা
তার রাজ্য এবং পতি দখলে মেরেই চলেছে ধর্মপ্রাণ। রাগের নিকট বরাবর ক্ষুদ্র হয়ে আসছে
বর্ষাকাল। তুমুল শীতে জন্মে তাই তোমার পথ অবধি বর্ষা। পৃথিবীর আশ্চর্য ঘটনাদের লাথি
মেরেছি নাকি কোলে তুলে এনেছি বুঝতে পারি না। আমার কলম আমার মাথার চেয়েও দ্রুত
দৌড়াচ্ছে আমি লিখতে পারছি না। সমস্ত মহাকাল একসঙ্গে লিখতে বসেছে আমাদের জীবন।
স্বযতনে রেখো প্রিয় মুখ নুরিন। যতনে যেন ভক্তি না কমে। দেবতা তুষ্ট করা সহজ কথা, জেনে
রেখো ক্ষমা প্রার্থনা কঠিন। মাটি ভেদ করে উঠে এসেছে যে বীজ সে জানে গোপনে কত বিষ।
পৃথিবীর শব্দদের লাথি মেরে বলো- কথা বলা হচ্ছে না, চুমু খাও মৃত্যু অবধি।
মাটি থেকে উপরে উঠে এসেছে পা, চোখ ভর্তি জাদুবাস্তবতা। তোমাদের সকলের উদ্দেশ্যে লিখে
যেতে হবে প্রচুর কথা। তোমাদের প্রতি আমার ঘৃণা এবং ভালোবাসার টইটুম্বর। তোমাদের হাতে
ফুটে আছে গোলাপ আমার হাতে টিউলিপ। কে কাকে পড়াতে শুরু করবে কুফুরি কালাম। আমি
তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চ বান্দা, আমি জানি খোদা কোথায় বসে খেলতেছে খেলা আর কারে
বলে ইবাদত। আমারে একদিন তাকাইয়া দেখো কাফের, আরেকদিন ফেরেশতা। ধর্মের
সুবিধাবঞ্চিত শয়তান আমি। আমারে বাদ দিয়ে যাবে না যাওয়া তোমার ওই পাড়েও। সেইখানেও
দেখা হবে খোলা হাতে বলে দিলাম এবং সেই দিনও স্বকন্ঠে পড়তে থাকবো- পবিত্র কবিতা পাঠ।
একদিন মরে যাবেন সে খবর বহুদিন পরে জানতে পারবো। তছনছ করে খুঁজে পাবো না আমাদের
সেদিনের দুপুরবেলার কোনো ছবি। তারপর হয়ত বহুবছর বাদে একদিন পঁচা ছেঁড়া বই ফেলে
দিতে গিয়ে দেখব একটা বৃষ্টিতে ভেজা কাগজ যেখানে লেখা- “আমরা বাঁচব” এবং অদ্ভুত এক
বিরল অক্ষরে লেখা আপনার নাম। সেদিন কেমন লাগবে জানি না। আজ ভালো লাগছে। কেউ
মাথা তুলে বলতে শিখেছে- বেঁচে থাকা বিরক্তিকর। অথচ একইসাথে সেদিন কি আমার মনে
হবে! আমি একাই বেঁচে গেছি যেভাবে বেঁচে থাকলে মানুষ রোজ ঘুমায়, খায়, আদর করে, গাছ
লাগায়। মরে যাওয়ার দৃশ্যের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বসে একটা রাজহাঁস উঁচু করে ফেলেছে
মাথা। পুকুরের মাঝখানে নেই কোনো মৃত্যু কারণ তবুও হাঁসেদের ডানায় আসে জিবরাইল।
ভোররাতের রাস্তা ঝাড়ু দেয়া এক বিরল দৃশ্য পৃথিবী ঝাড়ু দেয়ার। প্রায় সকল শহরেরই আর্বজনা
রাতের আধারে পরিষ্কার হয়। আলোতেই থাকে সব পাপ। কবুতরের মরাকান্না একদিন আর করুণ
লাগবে না। মরাকান্নাই একমাত্র মিথ্যা আচরণ। আদরের কাছে বিক্রি হওয়া বিড়াল সব আদরেই
ঘুমায় আর ঘুম ভাঙলে একমাত্র সত্যি কথা হলো ক্ষিধা। যে ক্ষিধা স্বীকার করতে পারে সে খুনও
করতে পারে। খুন মূলত আত্মহত্যার চেয়ে বেশি সুন্দর। অন্তত খুনি জানতে বা জানাতে পারে তার
সুখে থাকার নিশ্চিয়তার চেয়েও সুখটা কতবেশী নিশ্চিত। আত্মহত্যাকারী সেখানে সুখ বা সাহস
কারোরই অধিকারী নয়। ঝরা পাতার মধ্যে আত্মমর্যাদা খুব বিশ্রীই লাগে। নর্দমায়ও তাকে সুন্দর
রাখতে পারে কেবল তার সজীবতা।
তবুও ভালোবাসার কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। আমি এত ক্ষুধার্ত, হয়ত ক্ষুধাও স্বয়ং আমারে
ভয় পায়। আমাকে ভালোবাসার শক্তি আল্লাহ যাদের দিছে তাদের পায়ের কাছের সব মাটি-বালু
জল হয়ে গেছে। তারা সবাই একটা সমুদ্রে ভেসে যাইতেছে মাবুদ। অগাধ অগাধ দুঃখের মধ্যে
একটা রক্তজবা কিহ ভয়ংকর ভাবে ফুটে উঠতেছে। আমাকে বাড়ি রেখে যে পথে তুমি ফিরে গেছ
সে পথ এখন রজনীগন্ধার পাতায় ভরে গেছে। আমাদের হাঁটা পথে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য বিড়াল।
তুমি কিহ দৌড়ে এসেছো বাড়ি? তুমি কিহ ক্লান্ত? তুমি কি একটু ঘুমাবা?
