হাওয়া-পুস্তক থেকে কবিতা
৩১
সব সময় এইটুকুই কি দাও তুমি? তাকে ঠকানোর কোনও অভিপ্রায়
তোমার নেই? কর্মহীনতায় ভরে গেছে পৃথিবী। সর্বত্র সাম্রাজ্যবাদের ফেলে যাওয়া
বীজ ও বিষ্ঠা। তার মধ্যেই একটা অনুজ্জ্বল পিঁপড়ের বেঁচে থাকার সমাপ্তিহীন অশ্রু
থমকে থমকে দাঁড়ায়। আসলে, ঠকে যাওয়ার ভয় তো তোমার ছিলই। যদিও
মৃত্যুকুপ তোমার সামনে তবুও ঘুমন্ত পৃথিবীর মধ্যে
বিলীয়মান হতে চাইলে তুমি। ভুলতে চাইলে সাপের অস্তিত্ব, পাখিটার
ফিরে আসবার আশা আর বিনয়ী ছদ্মবেশ। সাফল্যনির্ণয়ের পাশ দিয়েও গেলে না তুমি।
আয়ত্তে নিলে নিজেকে বিভ্রান্ত করার দারুণ মনোরঞ্জন। আহা—!
৩৪
আরও একবার তাকাও না কেন পেঁয়াজের দিকে? নিজেকে নিকুচি দিয়েও
কাঁদাবে তোমাকে। আরও একবার তাকাও হে। এই সংসার তোমার।
এই যে মশলার ঘ্রাণ এই যে বাষ্প, উনুন থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাওয়ার দেয়ালে দেয়ালে—
ভাবো, এরও জীবন রয়েছে। তুমি যার ঢেউয়ের কথা জানো, তুমি যার
প্রেমের কথা মানো, তুমি যার সুরাপাত্রে রোজ রাত্রে চুম্বন চুম্বন ঢালো—
তারও মরণ রয়েছে মর্মর রয়েছে, রয়েছে জন্মসন্তরণ।
এসো, এবার রসুনটিও কাটো। দীক্ষিত হও আরও কিছুক্ষণ।
৩৫
হেঁটে চলার গরিমা বলতে আমি যাকে চিনেছিলাম
তার সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার জীবনে।
প্রথমবার যখন তাকে দেখি—
পৃথিবীটা সবুজ। উজ্জ্বল পাখির ডানার মতোই তার চঞ্চলতা। আকাশটাও ঝলমলিয়ে ছিল
নীলে আর সাদায়। আমার তখন শেষ
ফিরে আসবার পালা। তবুও আশ্চর্য, আমার ভাষা সেদিন সে পড়তে পেরেছিল।
শেষবার, তার হয়তো শেষ। আমার বেড়িয়ে আসা।
পৃথিবীটা মেঘাচ্ছন্ন। তার মাথায় ছাতা।
৩৬
মনে করো, তুমি একটা অক্ষর।
গত বছর ব্যর্থ ছিলে, তার আগের বছরও তাই, আর এ বছর এখনও ঘুমাও তুমি—
অথচ তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে এক কলমের ভিতর দিয়ে
সফেদ কোনও পৃষ্ঠায়। পৌঁছাতে হবে কুমারী মায়ের জঠরে। একটা
কুমীর আর একটা ডুবোপাহাড় তোমার উপাদান। যাদের নিয়ে
বিছানায় উঠবে তুমি। ছিঁড়ে ফেলবে বালিশ। জগত্ তখন
রুই আর রুই-য়ে পৌঁছে যাবে শিল্পের কাছে। শিল্প—
একটা হোয়াইট হোল, একটা সুগন্ধিপাথর, একটা কামাতুর হিয়া।
৪৩
সেই কবে থেকে দু’চোখে পাহাড় বসে গেছে। নির্জন মেঘের ভিতর
ধুপধাপ নাচছে আকাশ-নক্ষত্র। ঘুমোবার আগের তোমরা পাঠিয়ে দাও তবে কেশর, পাঠাও
দ্যুলোক ঘূর্ণি।
কেঁপে কেঁপে উঠি ওই মহাসময়ের তলে। নিভে যাচ্ছে মনুষ্যের বাড়ি,
মৃন্ময় নীহারিকা। ওগো রাত্রিদেবতা, হে চিড়ল অন্ধকার—
দেহের গভীরে ক্যামন পাহাড়-শেকড় গেঁথে গেছে।
বলো, এই লীলাকাণ্ড কার? আয়ুষ্কাল-ঘিরে-ধরা ধুম্ররাশি
কে পাঠিয়েছে আমার চোখের ভিতর। কী কী সব ফুঁসে উঠছে এখন অবিস্মরণীয়।
৪৪
কালকে আবার দেখা হবে আমাদের।
কাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকো। আগলে রেখো নিজেকে। আর এই বিলীয়মান
সন্ধ্যাটাও।
কী অদ্ভুত নভোতল তোমার! কী আশ্চর্য উদাসীন পাহাড়!
যার রেখা ধরে হেঁটে গেলেই ঘুঘুদের বাড়ি।
আমরা যাব একদিন। বাড়ি গিয়ে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।
কী নাম বলব তখন তোমার? কী হও আমার—যদি জানতে চায়?
অসম্পর্কের নিঃসঙ্গতা?
হ্যাঁ, এর চেয়ে উপযুক্ত আর কী হতে পারে।
৪৬
মনসার ফণার মতো গাছ—
হাতির শুঁড়ের মতো ফুল—
তোমরা চাও না এখন ক্লিওপেট্রা আমার মধ্যে প্রবেশ করুক। খুব নির্জনতা
এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাক ভাস্করদার কবিতার মতো। বরং চাও-যে আরও একটা
হাওয়ার দিকেই ঝুঁকি না কেন। হিরণ শব্দের মতো ছোট্ট কোনও কুটিরে
সুন্দরতম আকাঙ্ক্ষা যেভাবে দোলে। বিশ্বাস করো, সেই কবে থেকে
একটা চন্দ্রবিন্দুর মতো বুঁদ হয়ে আছি নেশায়। অথচ, নগ্ন রুটির প্রচ্ছায়ারা
আমার রাত্রিগুলোকে হিম করে রেখেছে। যতক্ষণ না
ভাস্কর দ্রাক্ষার রস পৃথিবীকে নীলাভ আলোয় প্রজ্বলিত করছে
ততক্ষণ কোনও হাওয়াই আমাকে অতিক্রম করতে পারে না।