আভাগার্দ কবিতা ও মলয় রায়চৌধুরী
জয়িতা ভট্টাচার্য
মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে যখন পরিচয় তখন তিনি বয়সের নিরিখে সত্তর ছুঁয়েছেন থাকেন মুম্বই তে। তাঁর সঙ্গে কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি। মলয় রায়চৌধুরী মানে পাটনার ইমলিতলা বস্তি থেকে কলকাতা, হাংরি আন্দোলন, কবিতা লিখে হাজতবাস, সাহিত্য আন্দোলন করতে গিয়ে লণ্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়া বাতিল, রিজার্ভ ব্যাংকের চাকরি লখনৌ উত্তর প্রদেশ, ন্যাবার্ড এর কৃষি গবেষণা তদারকি,
এলেন গিন্সবার্গ-অক্টাভিও পাজের বন্ধুত্ব একের পর এক স্ট্রোক, আর্থারাইটিসের জন্য বিকল প্রায় আঙুল শয্যাশায়ী দীর্ঘ দিনের সহধর্মিনী প্রাক্তন মহিলা হকি খেলোয়াড় সলিলা দিদি, কোমড়ের নিচে থেকে অসার হতে থাকা বৃদ্ধের মগজ আর মগজাস্ত্র এবং কম্পিউটারে লেখা হয়ে চলেছে বন্যার মতো অজস্র অসংখ্য প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ উপন্যাস,কবিতা তার মধ্যেই। মুম্বই শহরে বসবাস।
তাঁকে নিয়ে হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা দেশে বিদেশে আরও, আরও অনেক কিছুর অথৈ।
আমি কে? কী আমার যোগ্যতা যে তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করব। প্রায় অসাধ্য
পরিমাপ করা এই সমুদ্রের জল!
প্রত্যেকটা দিন তিনি জাগিয়ে তুলেছেন নতুন কিছু তরুণ প্রাণে
সৃজনের খিদে।
জাগিয়ে তুলছেন আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলি যা ঘুমিয়েছিল। তারপর তিনি আমাদের নিক্ষেপ করলেন লেখার সমুদ্রে। একের পর এক প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতায় আমি হাবুডুবু আমি। আমায় অপত্য স্নেহ করতে করতে কবেই যেন তিনি নিজেই নির্ভর করতে শুরু করলেন আমার ওপর। কিভাবে যেন দিনগুলো কেটে গেছে শেষ দিকে তিনি তাঁর গুরুতর কষ্ট বেদনার কথাও বলে ফেলতেন কিন্তু সরে যাননি লেখা থেকে। শেষ একবছর অবিরাম লিখে গেছেন। কী লিখব তাঁর রচনা, তাঁর
অগাধ পাণ্ডিত্য সর্বগ্রাসী জ্ঞানক্ষুধা বিস্মিত করেছে আমায় স্তম্ভিত করেছে।
মলয়দার কবিতা নানা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে গেছে তেমন কবিতার অবয়র পাল্টেছে জীবনের প্রতিটি বাঁকবদলের সঙ্গে সঙ্গে।
১৮১৪ সালের জঁ মিলেটের সঙ্গে কী মিল বাংলা ভাষার লেখক মলয় রায়চৌধুরীর? একটি দেশের সুরক্ষা সৃষ্টিতে প্রথম সারিতে থাকে সে দেশের আর্ট কালচার শিল্পী তারপর আসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। এই দুই ভাবে জিতে যায় একটি দেশ। এটাই ঘটনা।
এই অর্থে আভা গার্দে শিল্প আন্দোলনের সূচনাপর্ব যদি ফ্রান্সের গুস্তাভের তুলিতে হয়,বাংলা ভাষায় তবে মলয় রায়চৌধুরীর নাম সর্বাগ্রে। প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপদ পরম্পরাগত লেখন শৈলি ভেঙে শব্দ কে অপামরের অনুভূতি, ক্রোধ, প্রণয় সঙ্গম প্রত্যাশার কবিতা লেখার এই আন্দোলনকে আমরা হাংরি আন্দোলন বলে জেনেছি। সাল ১৯৬১,পাটনার বাড়িতে মলয় ও সমীর রায় চৌধুরী,শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বসে ঠিক করেছিলেন বাংলায় আভা গার্দে আন্দোলনের সূচনা। ইদানিং আত্মপ্রচারক রূপে খ্যাত মলয় কিন্তু হাংরি আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হাতে।নতুনদের মধ্যে এই আভা গার্দে কবিতার ভাষা ছড়িয়ে দেবার জন্য। মলয়দা বুঝেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা সমসাময়িক বাংলা কবিতা জগতে অনস্বীকার্য। হাংরি শব্দটি তাঁরই দেওয়া অবশ্য। শব্দটি
তিনি খুঁজে পেলেন চসারের। A Hungry sowre time থেকে।তিনি পড়েছিলেন ইতিহাসবিদ অসোয়াল্ড স্পেংলারের The Decline of The West, এ তুলে ধরা অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ব। হাংরি অর্থে তিনি বলতে চেয়েছেন পচনশীল সমাজের কথা। এক সর্বগ্রাস দুর্নীতি ও সামাজিক অবনমনের সমাজে পরিপাটি বানানো নকল কাব্য রচনার বিরুদ্ধে এই হাংরি জেনারেশনের কবিতার উদ্দেশ্য ছিল ভনিতা কে ধাক্কা দেওয়ার। পাটনা থাকাকালীন হাংরি বুলেটিন প্রকাশ হতে শুরু করে ইংরেজিতে।ঠিকানা দেওয়া থাকত দেবী রায়ের।আমরা জানি “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” কবিতাটির জন্য মলয় রায়চৌধুরীর কারাদণ্ড হয় পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরীর আদালতে তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য র পরে তার মুক্তি হয়। এটা উল্লেখযোগ্য যে
এই সময়খণ্ডে শুধু মলয় নয় তাঁর আন্দোলনে সতীর্থ রা
হাংরিয়ালিজম জনারে লিখেছেন অনেক রচনা। যেমন উৎপলকুমার বসুর “পোপের সমাধি”,শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “হে প্রেম হে নৈঃশব্দ”, শম্ভু রক্ষিত হাংরি আন্দোলনের হয়ে প্রকাশ করেছেন “ব্লুজ” ইত্যাদি। মলয়দার আভা গার্দে রচনাগুলি যা ওইসময়ের লেখা যেমন জখম, উপন্যাস ডুবজলে প্রশ্বাস, নামগন্ধহীন, চিৎকার সমগ্র প্রভৃতি আলাদাই দাগ রাখে বাংলা সমান্তরাল সাহিত্যে। প্রসঙ্গত মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত রচনা “মার্কস বাদের উত্তরাধিকার “প্রকাশ করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই শয়তানের মুখ প্রকাশ করে কৃত্তিবাস প্রকাশনী। হাংরি আন্দোলনে সামিল মলয় রায়চৌধুরীর সতীর্থ রা হলেন, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সমীর রায়চৌধুরী, শম্ভু রক্ষিত, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, বাসুদেব দাশগুপ্ত, রবীন্দ্র গুহ, ফাল্গুনী রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, সতীন্দ্র ভৌমিক, নীহার গুহ, ভানু চট্টোপাধ্যায়, হরনাথ ঘোষ, যোগের পাণ্ডা, তপন দাস, মিহির পাল, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুকুমার মিত্র, আলো মিত্র
প্রমুখ। পরবর্তীকালে আন্দোলন শেষ হয় ১৯৬৬ যখন আন্দোলন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই আন্দোলনের প্রভাব আজও অব্যাহত। প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটি পঞ্চাশ বছর পরেও জনপ্রিয়। কবিতাটি দেশ ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের এম ফিল ও পি এইচ ডি র গবেষণার বিষয় হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত Modern and Postmodern Poetry Of millennium সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র এই কবিতাটি স্থান পেয়েছে। মলয়দা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন স্কুলে যে বাংলা ক্লাসে কবিতা কি এটা পড়ানো হয় কিনা। না, সত্যিই আমাদের দেশে সিলেবাসে কিছু কবিতা থাকে তার প্রশ্ন ও উত্তর পাওয়া যায় সহায়িকা বইতে।কবিতা কি ও কেন একথা প্রথমে আলোচনা করা হয় না।
শিল্প সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর পরিভাষা ওখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“দৃশ্য বা অদৃশ্য কোনো ভাবরূপ শিল্পীর চিত্তরসে নবরূপায়িত হয়ে যে স্থিতিশীল রূপপ্রকাশ ঘটে তা-ই শিল্প। এ কলা মানব ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্রপূর্ণ এক দৃশ্য প্রকাশ এবং এ ধরণের কার্যক্রমের ফলে প্রাপ্ত পণ্য বা উৎপাদন। দৃশ্য বা সার্বিকভাবে বোধ্য শিল্প কলারই অজস্র রূপ।”
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার গঠন ও রূপ বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন কথা ও কাহিনী থেকে পুনশ্চ, যেমন ঝরা পালক থেকে ধূসর পাণ্ডুলিপি, সেরকমই মলয়দার কবিতার গঠন ও বিষয় বদলেছে কিন্তু এক্ষেত্রে কবির অবস্থান বদল হয়নি। বাংলা আভা গার্দ কবিতার
“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” থেকে “অবন্তিকা”— কবিতার এক ভিন্ন উৎসব উদ্জাপন করে।
মলয় রায়চৌধুরীর বিভিন্ন পর্বের কবিতাগুলোর মধ্যে “জখম” একটি বিখ্যাত কবিতা,
“চাদোয়ায় আগুন লাগিয়ে
তার নীচে শুয়ে আকাশের উরন্ত নীল দেখছি এখন
দু:খ কষ্টের শুনিনি মুলতুবি রেখে জেরা করে নিচ্ছি
হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামাফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি
আমার ভবিষ্যত
বুকের বাদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে মলয়ের কঙ্কাল জ্বালানোর ধোয়ায়
আশপাশ দিয়ে ঘন্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে ঝড়
কব্জিতে ঘড়ির কাটা রেখে চলে যাচ্ছে
সারসার সদ্বিঠ্যাং মানুষের লাভলোকসানময় দল…
১টা চামচিকে অনেক নিচু দিয়ে উড়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে
ওদিকে ফাকা মাঠের মধ্যে সাজানো রয়েছে
হাট-কোরে খোলা ৮০০০০০ কাঠের দরোজা
আমার সামনে সমস্ত দৃশ্য ধেবড়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি
কারুর সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না আমার
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
১৬ ডিভিসন কাক আমার হাত পা ধড় ঘিরে চক্কোর কাটছে ২৫ বছর…”
জখম কবিতাটা লেখা হয়েছিল ১৯৬৪ ও প্রকাশিত হয় ১৯৬৫।জখম একটি পোষ্ট মডার্ন কবিতা।
জখম একটি abstract কবিতা।কবিতাটি মলয়দার জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই সময়কার আদালতে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা, বন্ধুদের মুচলেকা দিয়ে সরে যাওয়া একা লড়াই করে ফিরে আসার ক্ষত বিক্ষত মন নিয়ে লেখা হয়েছে প্রতিটা ছত্র।কবিতাটি একেবারে সোজা সাপটা আন্তরিক আবেগের প্রস্ফুটন আরষ্টতাহীন। ব্যাংকশাল কোর্টে কিভাবে আইনের মারপ্যাচের খেলা হয়, আদালতেই ভাড়া পাওয়া যায় সাক্ষী, জেলের অভিজ্ঞতা এসবই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এই সময় এবং জখম কবিতায় তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।”একাই লড়েছিলুম কেউ বলেনি “হোক কলরব”
একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি দিয়ে
সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত”…দীর্ঘ এই কবিতায় একটি স্তবকে লিখেছেন’এখানে কেউ নিচু কোর্টে হেরে গিয়ে সদর কোর্টে জিতে ফিরে আসে।’
পরের পংক্তিতেই লিখছেন,
‘কেউ মানুষের কাছে জিতে গিয়ে মানুষের কাছে হেরে যায়।’
ক্ষত বিক্ষত মনের নিঃসঙ্গ কবির উচ্চারণ জখম।কবিতার মধ্যে ব্যবহৃত সংখ্যাগুলির মধ্যে রয়েছে বহুত্বর, উপচোনো ভাব,ছাপিয়ে যাওয়ার ইসারা, যুক্তির ফাটল,যা উত্তরাধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য। প্রবীণ সাহিত্য সম্পাদক বৈদ্যনাথ মিশ্র লিখেছেন, “নিজের জীবনে প্রকৃত টানা পাঁচ বছর দেম্মার,লাগাতার হুমকি, মানসিক টানাপোড়েনে উঠে আসে এভাবে সংখ্যা ও স্পেসের তারতম্য। “তাঁর কবিতায় বহু সত্যকে বিমূর্ত ইমেজ তুলে ধরেছেন। আবার বিষয়ের মধ্যে নিহিত জটিলতা সরাসরি স্পষ্ট করেছেন।”
পরবর্তীতে এপ্রিল ১,২০১৭ লেখা
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা “আদি টেম্পটেশন”_
মগজের বাঁদিকে ছান্দস, যা কিছু যোনির মতো দুই ফাঁক
বহু অন্ধকার তাহাদের রকমফের লয়ে আসে, যা কিছু যোনির মতো
হাসপাতালের পাঁচিলের পারে, যা কোনো যোনিতে গোপনে ছিল বাঁধা
যে বাসি রক্তমাখা তুলো,ওই রক্তই আমি, আকর্ষণের দেহতাপ রয়েছে তথায়
দেহ তো পাঠবস্তু, যোনির মতন দুই ফাঁক, পড়িতে না জানিলে
শবকে আগুন চাটে, ওই যে আঁস্তাকুড়ে মেয়ে-ভ্রুণ
ও-ভ্রুণের নাড়ির জমাট রক্তই আমি, একটি যোনি নষ্ট হয়ে গেল
শ্মশানে শ্মশানে ছাইয়ে আমি আছি, বহুযুগ, ঘায়ের নিষিদ্ধ রঙে
মটর ছোলার অড়হরে মুগের মুসুরের দুফাঁক যোনির অঙ্কুরে, আমাকে পাবেন
প্রতিটি যোনি দিয়ে গর্ভে গিয়েছি আমি
সাইক্লোনের ঘুরন্ত ল্যাজের ঝাপটের মতো
বাজার স্তনকে নিয়ে গেছে, বাজার যোনিকে নিয়ে গেছে, বাজার প্রেমকে নিয়ে গেছে
মুচকি দুঃখ-কষ্টের কিশোরীকে তুলে নিয়ে গেছে
সব নেবে, ওরা সব তুলে নিয়ে যাবে, প্রেম ভালোবাসা স্নেহ আদরের ছোঁয়া
ব্যথা শালা বলেনাকো কোথায় কবে কোনখানে আচমকা আঘাত দেবে
মরার পরের যন্ত্রণায়, লোভে উজ্বলমুখগুলো
আসবাব বলতে হাসি, মানুষের সংজ্ঞায় কিন্তু চুল নেই
মোমবাতিদের গান আছে, শীতের অলস সূর্যাস্ত, না,
তা আমি নই, আদালতে পেশ করা ছোরার রক্তই আমি, যোনিতে বসানো ছোরা
ব্যবসায়ীদের পোষা প্রেত ও প্রেতিনীরা, দরোজার ওই দিকে থাকে
বোমা মেরে থামিয়েছে সুফি গায়কের উল্লাস, তার ছিন্নভিন্ন দেহে
গান হয়ে আছি এখনও, তপ্ত যোনির মতো
দেয়াল ঘড়িতে যে গির্জা ঘণ্টাধ্বনি মাঝরাতে স্বপ্ন ভেঙে জাগে
স্লিপিং পিলেতে মোড়া ঘুম, চেতনার রঙিন ম্যাকাও পাখি দল বেঁধে
কোথাও না কোথাও ধ্বংস হচ্ছে কিছু-না-কিছু, তার হুঁশিয়ারি
শ্মশানের ডোমও জানতে চায়, ‘এনাকে কেউ কখনও ভালোবেসে ছিল’…
কবিতাগুলো আমরা যেমন পড়ে অভ্যস্ত তেমন নয়। শব্দ প্রয়োগে একটা পরম্পরাগত ছকে র বাইরে ধাক্কা দেওয়া শব্দ, কোথাও বা টানা যতি চিহ্ন বিহীন, সুরম্য সমসাময়িক গতানুগতিক কবিতা প্যাটার্নের বাইরে, চট করে মেনে নেওয়া কঠিন। অবশ্যই সর্বার্থে মার্ক্সিয় সাহিত্যের নব সংযোজন হতে পাবে। বহু প্রতিষ্ঠিত কবির কাছে তাঁর কবিতা সার্টিফিকেট পায় না যথারীতি কিন্তু জনপ্রিয়তার দিকে তিনি কখনও হাঁটেননি। লাবণ্য হীন এইসব কবিতা কখনও আর্থ সামাজিক প্রতিচ্ছবি,কখনও রোমান্টিক।
আভাঁ গার্দ একটি ফরাসি শব্দ। অর্থ ভ্যান গার্ড বা ফোর গার্ড। এই সামরিক রূপকটি সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় প্রথানুগত লেখালেখির থেকে পার্থক্য চিহ্নিত করার জন্য। কোনো ব্যক্তি,কাজ বা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয় যা নতুন, যা অপ্রথাগত।
মলয়দা তাঁর একটি আঁভা গার্দ কবিতাবলির সংকলন উৎসর্গ করেছেন সোনালী মিত্র, বিদিশা সরকার, জয়িতা ভট্টাচার্য সহ তাঁর “প্রণয়িণীবৃন্দকে”।শতাধিক কবিতার এই সংকলনে
অভিনবভাবে সময়কালকে একটি অসীম কালখণ্ড মেনে লেখা হয়েছে।
প্রতিটি কবিতা নিবেদিত হয়েছে বিভিন্ন খ্যাত ও বিস্মৃত ব্যক্তিত্বদের। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কবিতা নিবেদিত হয়েছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাহাদুর শাহ জাফর, মির্জা আবু জাফর সিরাজ, রচেস্টারের দ্বিতীয় আর্ল জনউইলমোট, দৌলত বেগম, সম্রাট বাবরের ঠাকুমা, বেলা বেগম সম্রাট হুমায়ুনের প্রথমা স্ত্রী প্রমুখ।কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে।
আভা গার্দ সাহিত্য শিল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ কারন তা নতুন একটি শৈলীর সূচনা করে।লেখক শিল্পীরা যদি সৃজনকে ঠেলে সামনে এগিয়ে না যেতে চায় তবে শিল্প সাহিত্য অপরিবর্তিত থেকে যেত। যারা এই এগিয়ে যাওয়ার দল, অজানা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সামনের সারির দল মলয়দা বলেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করে সমালোচকদের পোড়া ল্যাণ্ডমাইন, মিসাইল। ‘বাজার অর্থনীতির প্রকোপে ভাষা এক ভয়ঙ্কর বর্জ্য বয়ে নিয়ে চলেছে আভা গার্দ কবিতা ও গদ্য ভাষার এই অপচয়কে শত্রু মনে করে। আভা গার্দ এই পুঁজিবাদী, বস্তুবাদী প্রাতিষ্ঠানিক সৃজন সিস্টেমকে আঘাত করে। এবং পৃথিবীর যে কোনো দেশের মতোই আগুয়ান এই সব কবি শিল্পীরা তৎকালীন কোনো গ্রহনযোগ্যতা পায় না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় জয়েস,…
শিল্পোন্নয়ন
এ কী তুমি এইখানে পাগলাগারদে
পায়েতে শেকলবাঁধা নেয়ারের খাটে
উদোম উলঙ্গ শুয়ে আছো চুলে জট
নোংরা নক বেড়ে গেছে দুচোখে ঢুলুনি
সারাঘর বমি মুত পায়খানা ভরা
ভাতমাখা এনামেল থালা এককোণে
শরীর ধোওনি জলে নেমে কতদিন…
অন্যদিকে প্রেমিক মলয়ের প্রেমের কবিতাও বাংলা কবিতার আকাশে একটা নতুন রংচঙে ঘুড়ি।
আলফা ফিমেল বিড়ালিনী
ক্যাটওয়াকে শোস্টপার, শব্দহীন আলতো স্টিলেটো ফেলে দেহের আলোয়
মেলে ধরছিস তুই বাঁকের বদলগুলো হাসির হদিস তুলে, ঠিক যেন
ইমলিতলার তিনতলা থেকে বারবার ভাসাচ্ছিস দু-থাবার
তুলোট ম্যাজিক, অবন্তিকা, আলফা ফিমেল বিড়ালিনী, কোলে নিয়ে
আদর করিস যাকে তারই চরিত্র তোকে চেপে ধরে কালো শাদা বাদামি ধূসর
নক্ষত্র ক্লোনিং চোখে অর্গলছেঁড়া তোর লিভ-ইন কোনো পৌরাণিক
ঋষির রেশমি ঠোঁটে দরোজাবর্জিত কিছু অ্যাগ্রেসিভ আঁচড়-কামড় ;
তুই কি নীলাভ দূরত্বে থাকা অরুন্ধতী ? নাকি তুই
হবির্ভূ সন্নতি কলা অনসূয়া ক্ষমা শ্রদ্ধার কোঁকড়া ঘনান্ধকারে
দু-পাশে দর্শক নিয়ে ক্যাটওয়াকে হাঁটছিস দেশ-কালহীন ?…”
কিম্বা এই
রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দ,সুনীল প্রমুখ কবির কবিতার নারীরা অধিকাংশ সুররিয়ালিস্ট, কল্পনার ডানাকাটা পরী। তারা বাস্তবতার রুক্ষ মাটিতে unreachable, এব্যাপারেও মলয়দা প্রথা ভেঙেছেন। তাঁর কবিতাতেও এসেছেন বিভিন্ন নারী। “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার”এর শুভা থেকে সরে এসে লিখেছেন নীলার কাছে
“চাঁদের মতো নিরাময়ময়ী নীলা।
স্নানের পর নীলার শীতল আর নরম চামড়ার কচি আতর ভেসে আসছে।। “অথবা,রোমান্টিক উচ্চারণ, “এই রাত্তিরবেলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর চিৎ হয়ে আলতোভাবে শুয়ে লাজুক মাছেদের শিষ শোনার ইচ্ছে হচ্ছে আমার।”
মলয়দার সমগ্র কবিতায় লক্ষ্য করা যায় কথ্য ও ব্যবহারিক উচ্চারণকে লিপিবদ্ধ করতে, যা আভা গার্দ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য, শব্দ কে মেকাপ বিহীন রাংতা বিহীন নগ্ন রূপে পাঠকের সামনে রাখা যা তাদের যাপনের সঙ্গে মানানসই। সাময়িক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার পরোয়া করেননি মলয় রায়চৌধুরী। তাইত তাঁর শেষ পর্বের নারী অবন্তিকা কে নিয়ে একমাত্র লিখতে পারেন,
“মাথা বেয়ে ওঠে বুনো মহিষের সিং
ঝড়ের মস্তি দিয়ে পাউডার মাখিয়ে দিস অবন্তিকা “বা হরিণের নাচের সঙ্গে কাতুকুতু ” এমন সব অতিবাস্তব নিত্য ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগ করার ঝুঁকি, এমন অভিনবত্ব বাংলা প্রেমের কবিতায় মেটাফর ব্যবহার করার ঝুঁকি বোধহয় একমাত্র মলয় রায় চৌধুরী নিতে পেরেছেন ।
মলয় তাঁর কবিত্বের ভারী চোগাচাপকান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছেন এক স্বাভাবিক কামার্ত প্রেমিক। তাঁর সাহিত্য সত্ত্বা বিলীন হয়ে গেছে মানবসত্ত্বায়।
আর তাই তাঁর প্রিয় নারী “অবন্তিকা” এক ব্যতিক্রমী উত্তরাধুনিক নারী। মলয় অনায়াসে লেখেন,
“বোঁটায় তোর গোলাপ রং অবন্তিকা
শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা…প্রভৃতি
পূর্বে র কবিতার নারীদের এলিটিসম ও সৌন্দর্যের কনসেপ্ট ভেঙে একেবারে রিয়েলিস্টিক নারীর ছবি এঁকেছেন ইমলিতলার বস্তির বসবাসকারী সমাজের মূল স্তরের নারীর দেখা পাই তাঁর প্রেমের কবিতায়।
তার জন্য কোনও abstract কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না। অবন্তিকা বিড়ি খায়,লিপ্সটিক মুছে নেয় টিসু পেপারে।
মলয়দা লিখেছেন,”আভা গার্দ কবিতা ভাষা এবং পরীক্ষামূলক কবিতার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অন্বেষণ করে। “তিনি বলেছেন “ভাষাই বাস্তবতা। বাস্তবতা হলো ভাষা।”
আভাঁ গার্দ কবিতা এই চিরন্তন এক টানাপোড়েনের অধ্যায়।
জীবনের শেষ কুড়ি বছর শুধু লেখার মধ্যে কেটেছে মলয় রায়চৌধুরীর।
দিনরাত অজস্র লেখা।লিখেছেন গীতিনাট্য,প্যাসটিশ,দুটি ডিটেকটিভ উপন্যাস,
গল্প ও অসংখ্য প্রবন্ধ যা এখনও সব গ্রন্থস্থ হয়নি।
প্রসঙ্গত, অনুবাদক মলয়ের অবদান বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য।
অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল ও ক্যাডিশ কাব্য-গ্রন্থের অনুবাদ প্রভৃতি অন্যতম। তিনি বিট মহিলা কবিদের রচনা অজস্র অনুবাদ করেছেন, পরাবাস্তব কবিদের অনুবাদ করেছেন এবং জাঁ জেনের সমস্ত কবিতা অনুবাদ করেছেন। লোকনাথ ভট্টাচার্যের পর তিনি দ্বিতীয় বাঙালি যিনি জাঁ আর্তুর র্যাঁবো-র নরকে এক ঋতু এবং ইল্যুমুনেশান্স অনুবাদ করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর পর প্রথম বাঙালি যিনি বোদলেয়ারের সমগ্র কবিতা অনুবাদ করেছেন।
মলয় রায়চৌধুরী একজন বৈশ্বিক কবি।
বিদেশি কবি ওকতাভিও পাজ, আরনেস্তো কার্দেনাল, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ডেইজি অ্যালডান প্রমুখ ভারতে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ।
পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস থেকে তাঁকে নিয়ে দি হাংরিয়ালিস্টস নামে একটি গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে।
মলয় রায়চৌধুরী প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব বা কলকাতা লবি/সিন্ডিকেট ছাড়াই শুধু অবিরাম লিখে এবং লিখেই বিশ্ববিখ্যাত হওয়া সম্ভব। তিনি তাঁর অধিকাংশ লেখা আন্তর্জালিক সংরক্ষণ করে গেছেন যা চিরদিনের মতো সুরক্ষিত থাকবে বিশ্ব সাহিত্যের পারাবারে।
সাহিত্যের এমন কোনো ঘর নেই যেখানে মলয়দা দখলদারি করেননি কিন্তু তবুও
শেষ পর্যন্ত মলয় রায়চৌধুরী আষ্টেপৃষ্টে কবি, তাঁর সমগ্র সত্ত্বায় কবিতা, আনন্দ বা দুঃখে, সমগ্র চেতনায় কবিতা।
“দুঃখ
মগজে নয়
সমস্ত শরীরে
দুঃখ আছে ছেয়ে
মাকড়ের জাল
রস শুষে নেয়া
আধমরা কীট
হাড়- মজ্জায়
রক্তে-মাংসে
ব্যথা নয়
যন্ত্রণা নয়
বিষাদও নয়
অপরিসীম
শুধু দুঃখ
কোনো ব্যাখা
জানি না কেন
নেই।”
