উত্তর চেতনা: তৃতীয় দশকের চ্যালেঞ্জ
জিললুর রহমান
উত্তর চেতনার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩ সালের মে মাসে। এই মহতী
আয়োজনে বিদেশ যাত্রায় ছুটিছাটা সংক্রান্ত কিছু বিধিনিষেধ আরোপ থাকার কারণে সে যাত্রায়
সশরীরে হাজির হতে পারিনি। এই মনোবেদনা দূর করা সম্ভব নয়। তবে, আমি স্থির নিশ্চিন্ত যে
২০১৯ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে অনুষ্ঠিত উত্তর চেতনার প্রথম আন্তর্জাতিক
সম্মেলনের তিনদিন ব্যাপী উৎসবমুখর যে পরিবেশে আমরা উত্তর চেতনার দিকে অগ্রসর হবার
যাত্রা শুরু করেছিলাম, এক’বছরে সে পথ অনেক দূর পর্যন্ত আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
তার পর থেকে এই উত্তরচেতনা সংক্রান্ত নানান আলাপ আড্ডার ভেতর দিয়ে এই দার্শনিক
প্রপঞ্চ এরই মধ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন অভিক্ষেপের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে।
আমার মনে আছে, বালুরঘাট সম্মেলনের উদ্বোধনকালে আমি প্রায় এক ঘন্টাব্যাপী বক্তব্যে উত্তর
আধুনিকতা চর্চায় বাংলাদেশে লিরিক পত্রিকা এবং আমাদের যে দীর্ঘ সংগ্রামমুখর পথ চলা তা
বিশদ তুলে ধরেছিলাম। আজ যখন উত্তর চেতনা অভিধা গ্রহণ করে পথটিকে আরো
আলোকোজ্জ্বল করে এগিয়ে নেবার চেষ্টা চলমান, তখনও আমি জানি, এ পথ আরও দুর্গম হবার
সম্ভাবনা বেশি। কারণ, এবারে আমাদের সঙ্গীদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ উত্তর আধুনিকতা
অভিধাটি আঁকড়ে ধরে রেখে আধুনিকতাবাদীদের সাথে ফ্যাসাদে লিপ্ত থেকে বাজার গরম রাখার
মানসিকতায় উত্তর চেতনা অভিধা পরিহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আমি আপনাদের স্মরণ
করিয়ে দিতে চাই যে পোস্টমডার্নিজম এবং উত্তরআধুনিকতা “সমমাত্রিক বিপরীত অভিঘাত”
হিসেবে প্রায় কাছাকাছি সময়ে আমাদের জলহাওয়াতে বিকশিত হতে থাকলেও, দুই মতবাদই
তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-আলোচনার জন্যে সবসময় আধুনিকতাবাদের উপর নির্ভরশীল,
আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করে, তার ত্রুটিবিচ্যুতি-অবক্ষয় ইত্যাদি চিহ্নিত করেই এদের
চরিত্রলক্ষণগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হয়। সে-অর্থে আধুনিকতার বিরোধিতা করেও এরা
আধুনিকতাবাদের উপর এক-অর্থে নির্ভরশীল। যতবার আমরা উত্তরআধুনিকতা নিয়ে চিন্তা
করতে বসি, ততবার যেন আধুনিকতাবাদের সেই আগ্রাসী হাত আমাদের আক্রমণ করে বসে।
উপরন্তু, পোস্টমডার্নিজমের ভূতও উত্তরআধুনিকতার ঘাড়ে চেপে বসে।
বহু আড্ডা-আলোচনা এবং সেমিনারেও ‘উত্তর’-এর সাথে লাগোয়া ‘আধুনিক’ নিয়ে আমরা বেশ
বিতর্কে মেতে উঠেছিলাম। অন্য দিকে, উত্তরআধুনিকতা বিষয়ে যারা কাজ করেছেন তারা
যতোটা ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মগ্ন থাকেন, সে-অর্থে বিজ্ঞান-চেতনা, মহাবিশ্ব, সময়চিন্তা এবং
ভূ-রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাদের বক্তব্য ততোটা জোরালোও ছিল না। এদিকে, উত্তরআধুনিক
চেতনা বিষয়টি সার্বিক একটা ব্যাপার হিসেবে প্রস্তাবিত হলেও, পরবর্তীকালে অনেকে এটাকে
নিছক সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে ধরে লেখালেখি করেন।
আবার, আধুনিকতাবাদ দীর্ঘকাল চলমান শোষকশ্রেণীর একটি চালিকাশক্তি হলেও, ‘অধুনা’
শব্দবন্ধটি মূলতঃ ‘সম্প্রতি’র সমার্থক, যা অতি-ক্ষণস্থায়ী এবং প্রতিনিয়ত অতীতের অতল গহ্বরে
হারিয়ে শ্বাশ্বত চেতনায় উন্নীত হয়। তাই ‘অধুনা’ বলে কার্যত কিছুই থাকে না, কালচেতনায়
আমাদের সামনে থাকে কেবল ভবিষ্যৎ আর ভবিতব্য, যা অজ্ঞেয় বা দুর্জ্ঞেয়। তাহলে
উদ+তর+অন অর্থে যে উত্তরণের কথা জ্ঞানকাণ্ডের চর্চায় বর্ণিত হচ্ছে, তা ইতিহাস আর
ঐতিহ্যের সাথে অন্বয় সৃজনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে দূরদৃষ্টি প্রসারিত করা; এক
মহাজাগতিক মূল্যবোধের অন্তঃসলিলা স্রোতে কাল থেকে কালান্তরে পরিভ্রমণ করে নিজেকে
এই মহাজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কর্তব্যপরায়ণ কণিকারূপে অনুধাবন করা।
লাতিন আমেরিকার লেখক ও সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানো বলেন, “বিজ্ঞানীরা বলেন যে,
মানুষ তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে। কিন্তু একটা ছোট্ট পাখি আমাকে বলেছে, আমরা গল্প দিয়েও
তৈরি”। এই মহাবিশ্ব কবে কোন সালে কোন মহাযজ্ঞ সম্পাদন লক্ষ্যে আবির্ভূত হয়েছে, তা
আমাদের কারও জানা নেই। শুধু এক-মহাবিস্ফোরণের গাণিতিক সমীকরণ আমাদের প্রতীতি।
আমরা এই পৃথিবীবাসী ছাড়াও অন্য কোনো গ্রহে আর কোনো প্রাণী আছে কিনা তা’ও আমাদের
অজানা। শুধু এটুকু জানি, চাঁদে হয়তো পানি মিলে যাবে, মঙ্গলে হয়তো বসতি করা যাবে। হয়তো
কোথাও কোনো প্রাণী কোনো জীবও আবিষ্কৃত হবে। তবে, আজকের এই বিজ্ঞানের প্রযুক্তির
অভিনব উল্লম্ফনের যুগে জগতের সকল কিছুই প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের উপাদানে রূপান্তরিত
হওয়ায় আমরা যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তার ফলে আমাদের
ভবিষ্যৎ কোন পথে এগুবে? আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর আগে মানুষ তো ছিলো না, ছিলো
হোমো-স্যাপিয়েন্স এর আগের প্রাণী নরবানরগণ। তাদের না-ছিল বিজ্ঞান, না-ছিল প্রযুক্তি।
হয়তো সমাজবদ্ধ জীবন ছিলো, তবে মানুষের মতো ছিল না। আজ বিভিন্ন ফসিল তাদের
উপস্থিতির খবর দেয়। আমরা যেভাবে এন্টিবায়োটিক যুগের শেষদিকে চলে এসেছি, খুব শীঘ্রই
আবার ফিরে আসবে ব্যাকটেরিয়ার শাসন। তখন আমাদের পরবর্তী-প্রজন্ম যদি টিমটিম করে
বেঁচে থাকে, সেদিন হয়তো তাদের ইতিহাসে লেখা থাকবে, মানুষের একটা স্বর্ণযুগ ছিল, যখন
মানুষ ব্যাকটেরিয়াদেরকে মারতে জানতো, দীর্ঘ আয়ুষ্কাল এবং সুস্থ-জীবন পেতো। আমরা ভুলে
যাই, বিগত বরফ-যুগেরও আগে কমপক্ষে আরও ৪টি বরফ-যুগ পার হয়েছে। প্রতিবার পৃথিবীর
প্রাণীকুল ধ্বংস হয়েছে, লুপ্ত হয়েছে নানা-প্রজাতির জীব। নূহের বন্যার আগে আরও-আরও
বন্যায় ভেসেছে পৃথিবী। আমরা মনে রাখি না কোটি বছর ধরে কিন্তু ব্যাকটেরিয়া টিকে আছে।
মানুষ যে জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নতি করেছে, সে-কেবল মানুষের পর্যায়ক্রমে বানরতুল্য-অবস্থা থেকে
নরবানর এবং তৎপরবর্তী হোমোস্যাপিয়েন্স হওয়ায় সম্ভব হয়েছে। মানুষ সামনের পা-গুলোকে
হাঁটার কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছে বলেই এবং মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে
দাঁড়াতে পেরেছে বলেই হাত ও মাথাকে ভিন্নকাজে ব্যবহার করতে পেরেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
মাধ্যমে বিশ্বকে কব্জা করেছে। কিন্তু এই পৃথিবীতে সব মানুষের যেমন সমান অধিকার, অন্য
সকল জীবজগতেরও সমান অধিকার রয়েছে। কেবল জীবন বাঁচানোর চক্রে একে অপরকে
ভক্ষণ করা প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আজ মানুষ তার প্রযুক্তির স্বার্থে ধ্বংস করে দিচ্ছে বন,
জলাশয়-সহ নানান জীব ও প্রাণী। এই ভারসাম্যহীনতা খুব শিঘ্রই ডেকে আনতে পারে সমূহ-
বিপদ। তাই আমাদের মনে রাখা উচিত সমুদ্রের যে ঢেউটি মাথা উঁচু করেছে, তার মাথাকে ঠেলে
আরো উঁচু হয়ে দাঁড়াবে পরবর্তী ঢেউ। আবার এক-একটি ঢেউ পূর্ববর্তী ঢেউকে সামনের দিকে
এগিয়েও দিয়ে যায়।
সমুদ্রের তীরে দাঁড়ালে কিংবা সুউচ্চ পর্বতের সামনে দাঁড়ালে, অথবা কোনো প্রাচীন ভগ্নস্তুপের
সামনে হঠাৎ উপস্থিত হলে যে বিশালত্বের অনুভূতি জাগে, এমনকি কোনো কবরস্থানের দিকে
গভীরভাবে দৃকপাত করলে যে অসীম শূন্যতা এসে ভর করে মনে— এই অসীমের নন্দন-চিন্তাই
প্রকারান্তরে ‘উত্তরচেতনা’। এই প্রসঙ্গের প্রাথমিক সূত্রপাত অমিতাভ গুপ্ত রচিত ‘অসীমের
নন্দন’ গ্রন্থে।
“জীবন উদ্দেশ্যহীন নয়, আবার অর্থময়ও নয়, এর গন্তব্য হয় না, আবার এর কাঠামো
চারিত্রিকভাবে গন্তব্য নয়। মানুষও অন্য প্রাণীর মতো, পাখির মতো, মাছের মতো, পিঁপড়ের
মতো, গাছের মতো। … প্রতিদিনের এই বাঁচা, প্রতিদিনের এই ক্ষয়ের মাঝে সাঁতার-কাটা মানুষেরা
কি বুঝতে পারে, জীবন তাদের হাতের মাঝে গলানো পানির মতন পড়ে যায়?” একটি বরফ-যুগ
থেকে আরেকটি বরফ-যুগের মধ্যে কোটি-কোটি বছরের ব্যবধান। কিন্তু মহাকালের কাছে তা
সামান্য কয়েকটি সংখ্যামাত্র। উত্তরচেতনা এই কাল-সংযোগ, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, ইতিহাস-
ঐতিহ্যের যথার্থ প্রয়োগ, পরিবেশচিন্তা, সর্বোপরি ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে— উচ্চারণ
করে “চরৈবেতি, চরৈবেতি”। আর পরবর্তী বরফ-যুগটি যাতে ঠেকানো যায় কিংবা বিলম্বিত করা
যায়, আমাদের সংস্কৃতি যেন তেমন-তেমন পরিবেশ তৈরী করতে পারে। তাই আজ আমাদের
“রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ করনি”-সুলভ আচরণ ও সংস্কৃতি থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে
আরো-আরো মানুষ হয়ে ওঠার জন্য নিয়ত সংগ্রামমুখর থাকতে হবে। আমাদের সামনে শুধু
এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
‘উত্তরচেতনা’ অভিধাটি কবি অমিতাভ গুপ্ত প্রথম ২০১৭ সালে মেদিনীপুর কলেজের একটি
সম্মেলনে উচ্চারণ করেন। ২০১৮ সালের ১৫এপ্রিল জিললুর রহমান সম্পাদিত ছোটকাগজ
‘যদিও উত্তরমেঘ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘মহাকবিতার সন্ধানে’ শীর্ষক বক্তৃতাসভায় কবি
অমিতাভ গুপ্তের কন্ঠে ‘উত্তর চেতনা’র প্রস্তাবনাটি জোরালোভাবে পেশ হয়। উত্তরচেতনার
সংগঠনে উত্তরআধুনিক চেতনার মূল তিনটি উৎস— জ্যোতির্বিজ্ঞান, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং
ন্যায়শাস্ত্রের দর্শনপ্রস্থান, যথাস্বরূপেই রয়েছে। কবি অমিতাভ গুপ্তের প্রবন্ধ ‘জ্যা’-তে উত্তরচেতনা
প্রসঙ্গে প্রথম লিখিত বক্তব্য আসে। প্রজন্মের পর প্রজন্মাতীত মঙ্গলকামনা ও ত্যাগের,
ইতিহাসের এবং ইতিহাসাতীতের, আসন্নের এবং অনাসন্নের প্রতিটি প্রকৃত-সত্য অন্তর্লীন হয়ে
রয়েছে মানুষের শিল্পকৃতির মধ্যে। মানুষের হাজার বছরের কীর্তির ভেতরে, মন্দির-মসজিদের
জীর্ণ-কাঠামোয় এবং চট্টগ্রামের সমুদ্র-উপকুল থেকে সুন্দরবনের হীরণপয়েন্ট পর্যন্ত মানুষের
পাঁজরসর্বস্ব বুকে না-খেতে পাওয়া ক্লেশের প্রতিজ্ঞায় ধৃত ভবিষ্যতের আলপনায় মিশে যেতে হয়
আমাদের সমস্ত শিল্পকে, সব কবিতাকে। এই সৃজনে-নির্মাণে পুনর্নির্মাণে কোনো অধুনা নেই,
আধুনিক নেই, আধুনিকতা নেই। রয়েছে শুধু উত্তরণের পরে উত্তরণ, অন্তহীন অসীম চিরকালের
উত্তরণ।
১৯৯২ সালে রচিত ‘Moments of Infinity’ শীর্ষক অমিতাভ গুপ্তের প্রবন্ধের সূত্রে বলা যায়,
অসীম অবিচ্ছিন্ন এবং অবিচ্ছেদ্য ক্ষেত্রকালের মহাদ্রুতিময় মাত্রায় অধুনা বা আধুনিক বলে কিছু
হয় না। তাই চট্টগ্রামে এবং পরে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বালুরঘাটে প্রথম আন্তর্জাতিক
সম্মেলনে ‘উত্তরআধুনিক’ শব্দবন্ধ থেকে ‘আধুনিক’ শব্দটি ছেঁটে ফেলার পক্ষে ব্যবহারিক যুক্তি
প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তরচেতনা নিবিড় অন্বেষণের মধ্যে আন্তর্বয়ন থেকে অন্তর্বয়ানে যাত্রার কথা
বলে। জুলিয়া ক্রিস্তেভা গতশতকের ষাটের-দশকে আন্তর্বয়ানের যে তত্ত্ব প্রদান করেন তা’
অনবদ্য। ক্রিস্তেভার আগে জীবনানন্দ দাশের মহাকবিতার ধারণায় এ-তত্ত্বের আভাস পাওয়া
যায়। উভয় ধারণাকে সংশ্লেষিত করে ব্যক্তিমানসের ক্ষেত্রে এবং মিলিত ব্যক্তিচেতনার ক্ষেত্রে যে
অন্তর্বয়ানের সন্ধান পাওয়া যায়, উত্তরচেতনার জন্যে সেটি এক প্রধান অভিমুখ। অন্য অভিমুখে
রয়েছে সার্বিক মঙ্গলকামনা। বুর্জোয়া মানবতাবাদে ক্লিষ্ট-ক্লিন্ন আধুনিকতা বা আধুনিকতার
কোনো শাখাপ্রশাখা দিয়ে এই মঙ্গলকামনাকে বোধগম্য করা যাবে না। গরীবের কষ্ট দেখে চোখের
জল ফেলতে ফেলতে কিংবা না-ফেলে অনেক সাব-অলটার্ন লেখা হয়েছে বাংলায়। এবার উত্তর
চেতনাকে পরিপূর্ণ সার্বিক মঙ্গলকামনায় প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে হবে। যেন মঙ্গলকামনাই
হয়ে ওঠে একমাত্র কামনা। এই কামনার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও জটিলতা, রূপ ও অপরূপ শব্দ ও নৈশব্দ—
সবই যেন ধরা দেয় উত্তরচেতনার কবিতায় কিংবা শিল্পকৃতিতে।
২০১৯ সালের বালুরঘাট সম্মেলনের পরে আমরা এক দীর্ঘ বিবর্ণ সময়কাল অতিক্রম করেছি,
যাকে আমরা অতিমারী বলে চিহ্নিত করেছি। আমরা সকলেই আত্মস্থ করতে পেরেছি যে, মানুষ
যতোই চাঁদে বা মঙ্গলে যাক, যতই মহাকাশে জেমস ওয়েব পাঠিয়ে ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো
নক্ষত্রের ছবি তুলুক, যার অস্তিত্বই বর্তমানে নেই , সেই মানুষ সামান্য একটি ভাইরাসের ক্ষমতার
কাছে কতটা অসহায়, যে ভাইরাসটিকে এমনকি মাইক্রোস্কোপের নীচেও দেখা যায় না। এইসব
ক্রান্তি আমাদের কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা করোনাক্রান্তি জয় করে প্রমাণ করেছি
“ব্যক্তি মরে বটে মানুষ বেঁচে থাকে”; অর্থাৎ সম্মিলিত মানুষের অগ্রযাত্রা উত্তরণমুখী।
আমি কবিতামগ্ন মানুষ। এই সময়টা আমি কেবল কুঁকড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকিনি। আমি জানি,
বিশ্বাস করি, আপনারাও অদম্য কাব্যশক্তিতে ভর করে নতুন ভোরের ক্যানভাস এঁকে গিয়েছেন
কবিতা গল্প বা চিত্রকলায়। এর মধ্যে আমার রচিত কাব্য ‘আত্মজার প্রতি ও অন্যান্য কবিতা’,
‘পপলার বন মরে পড়ে আছে’, ‘হঠাৎ রাজেন্দ্রপুর’ এবং ‘এক সে মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি’
প্রকাশিত হয়েছে। সকলের কাছে হয়তো তার মর্মধ্বনি পৌঁছাতে পারেনি ধনবাদী প্রপাগাণ্ডা এবং
আন্তর্জালিকার অদৃশ্য বাণিজ্যিক দেওয়াল পেরিয়ে। তবে, এদেশের কবিতার পাঠকদের মধ্যে
আমি গভীর ধনাত্মক সাড়া অনুভব করেছি। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আমার গদ্যগ্রন্থ ‘উত্তর
চেতনার ভূমিকা’ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত উত্তর চেতনাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য
পুস্তকাকারে এটাই প্রথম প্রয়াস। আশা করি, আমার ওই ক্ষুদ্র প্রয়াস গবেষক ও দার্শনিকদের
বিস্তারিত পুস্তক রচনায় আগ্রহী ও ব্রতী করে তুলবে। কেবল এটুকু বলা যেতে পারে, উত্তর
চেতনার মধ্যে দিয়ে আমাদের দার্শনিক বীক্ষা, যৌথচিন্তা ও প্রগতির সপক্ষেই তার শেকড়নিষ্ঠ
পথ তৈরি করে নেবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বাংলা এক অদ্ভুত দেশ, যা দখলে নেবার সাহস পায়নি আলেকজান্দার
পর্যন্ত। ইখতিয়ারের আচমকা দখলের কিছুকাল পরে সুলতানী আমলে বাংলা আবার
স্বাধীনভাবেই শাসিত হয়েছে। এমনকি মুঘল ডাইনাস্টির সবচেয়ে পরাক্রমশালী সম্রাট আকবরের
সময় বাংলা স্বাধীন ছিল, বার ভুঁইয়ার শাসনে, ঈসা খাঁ’র নেতৃত্বে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনের
সময় মুসা খাঁ বীরদর্পে লড়াই করে পরাজিত হলে বাংলা মুঘল শাসনে যায় এবং পানাম নগরের
পতন ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে ঢাকার সূচনা ঘটে। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর নেতৃত্বে বাংলা আবার
মুক্ত হয় বটে, কিন্তু সিরাজের পরাজয়ে ব্রিটিশের শাসন শুরু হলে নানা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে
বাঙালির জাত্যাভিমান একটা নির্দিষ্ট রূপরেখা পায়। ১৯৪৭-এ দেশভাগের মধ্যদিয়ে দ্বিখণ্ডিত
বাংলার যে অংশে আমাদের নিবাস, তার জন্ম থেকেই বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের
দিকে ধাবিত হয়। ১৯৭১-এ অর্জিত বিজয় যে স্বাধীনতা এনে দেয় তা’ও বিঘ্নিত হয় নানা হঠকারী
ফ্যাসিবাদী সিদ্বান্ত, এবং সেনা অভ্যুত্থানের জন্য। আজ ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে
ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটলে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে নতুন দর্শন ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে
সামনের দিকে এগিয়ে যাবার। এমন দিনে আমাদের সুযোগ এসেছে শেকড়ের সন্ধান করার;
আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সুদৃঢ়রূপে ধারণ করে বিজ্ঞান ও স্বাধীন মনের বিকাশ ঘটানোর।
তাই উত্তর চেতনা বিকাশের উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ।
একই সাথে একথাও ভাবার সময় এসেছে বহুমত এবং বহুদর্শনের একই ভৌগলিক এবং
সময়কালের সীমারেখায় দলাদলি নয়, বরং পাশাপাশি গলাগলি করে অবস্থান করার ভেতর দিয়ে
আমাদের অগ্রসর হতে হবে। রাষ্ট্রচিন্তায় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব যেমন দরকার, তেমনি সকল
মতের এবং দর্শনের সহাবস্থানই তৈরি করতে পারে সুন্দর মনুষ্য সমাজব্যবস্থা।
রচনাকাল: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
দুপুর ০২:০০
