চারুলতা (১৯৬৪)
শিশির আজম
‘চারুলতা’ কি পলিটিক্যাল ফিল্ম না রোমান্টিক? এরকম ভাবনা দর্শকের মনে উঁকি দেওয়া
স্বাভাবিক। আমরা জানি, সত্যজিতের সিনেমায় রাজনীতি-দর্শন-যুক্তিবোধ যেমন আছে, তেমনি
মনও আছে। আর ‘চারুলতা’য় মন আছে বেশ জোরালোভাবেই। বলা যায়, ‘চারুলতা’ মনেরই
খেলা, বিশেষত নারীর। এ-সিনেমা চারু নামের একাকী এক মেয়ের মনোজগতের নিঃসঙ্গতার
কারুকাজ। না কি এ মন সত্যজিতেরই মন! সত্যজিতের সিনেমায় তো বটেই সম্পূর্ণ বাংলা
সিনেমায়ই’ চারু’র সঙ্গে তুলনীয় এরকম মনোজিজ্ঞাসামূলক চরিত্র দ্বিতীয়টি আর নেই, এটা
নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ‘চারুলতা’য় সদ্যযৌবনা চারুই প্রধান চরিত্র যে কম কথা বলে। প্রথম সাত
মিনিট তো পরিচালক তো তাকে দিয়ে কোন কথাই বলাননি, মাঝে একবার চাকর ব্রজকে ডাকা
ছাড়া। সে যা দেখে অন্যরা তা দেখে না, বা দেখার সময় পায় না, বা দেখার মতো মন তারা পায়নি।
ভাগ্যিস পায়নি! না হলে তাদেরও তো আড়ালে-অবচেতনে গুমরে গুমরে কাঁদতে হতো। যেটার
দরকার পড়েনি উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের কর্তা বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় অনুপ্রানিত ভূপতির
ক্ষেত্রে। ‘ভূপতি’ চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। ‘চারু’ আর ‘অমলে’র
ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে মাধবী মুখোপাধ্যায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রতিটি
চরিত্রেরই মানসিক দ্বন্দ্বে ভিন্নতা রয়েছে। বেশ শক্তপোক্তভাবেই রয়েছে। কিন্ত সবকিছু যেন
একটা জায়গায় পৌঁছানোর সিড়ি। সিঁড়িটা দর্শককে চারুর দ্বন্দ্বময় মনস্তত্বের কাছে পৌছাতে
আহ্বান করে। সিনেমাটা সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ১৯৬৪ সালে। এর কাহিনী রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’
গল্প থেকে নেয়া। মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাজকারবার তো আমরা জানিই। নিশ্চিতই রবীন্দ্রনাথ
সত্যজিৎকে উশকে দিয়ে থাকবেন। ‘ঘরে-বাইরে’, ‘গোরা’ বা ‘চোখের বালি’– কোথায় নেই
রবীন্দ্রনাথের মন নিয়ে খেলা? হ্যা, এইসব উপন্যাসে রাজনীতি আছে, সামাজিক অবিচার-
নিষ্ঠুরতা-কুসংস্কার আছে। তবে মনের জন্যও জায়গা রাখতে ভুল করেননি রবীন্দ্রনাথ, বিশেষত
‘চোখের বালি’তে। ‘চারুলতা’য় মিউজিক বড় একটা ব্যাপার। মিউজিকের কাজ সত্যজিৎ নিজেই
করেছেন। আমরা জানি, একইসঙ্গে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য, উভয় সংগীতেই সত্যজিতের কি ঈর্ষণীয়
দখল ছিল। আর সাবলীলভাবে সত্যজিৎ ‘চারুলতা’য় এর যথাযথ ব্যাবহার করেছেন। কিন্তু শেষ
অব্দি এটা ভারতবর্ষেরই ছবি, বাংলারই ছবি। এটা দর্শক হিসেবে আমাদের বিস্মিত না করে পারে
না। হ্যা, ‘অপু ট্রিয়োলোজি’ (‘পথের পাঁচালী’-১৯৫৫, ‘অপরাজিত’-১৯৫৬, ‘অপুর সংসার’-১৯৫৯)
আর ‘পরশ পাথর'(১৯৫৮)-য়ে রবিশঙ্করের মতো পন্ডিত মিউজিকের কাজ করেছেন, ‘জলসাঘর’
(১৯৫৮)-য়ে বিলায়েত খাঁ, ‘দেবী’ (১৯৬০)তে আলি আকবর খাঁর মতো মহারথী মিউজিক
করেছেন। তবে সত্যজিৎ তার নিজের সিনেমায় মিউজিকের যে কাজ দেখিয়েছেন সেটাকে কী
বলা যায়? এ প্রশ্ন আসতো না যদি তার সিনেমায় রবিশঙ্কর, বিলায়েত বা আলি আকবরের মতো
ওস্তাদগণ কাজ না করতেন। এদের কাজের পর নিজের সিনেমায় সত্যজিতের নিজে মিউজিকের
ভার নেয়াটা কি রিস্কি ছিল না? না ছিল না। কেন না মিউজিক ওর রক্তে ছিল। আর ছিল মিউজিক
শোনা, মিউজিক পড়াশোনা, মিউজিক নিয়ে নতুন ভাবনা-দর্শন। ভারতবর্ষে সিনেমায়
মিউজিকের ব্যাবহারের কথা বললে সত্যজিতের পাশে কেবল ঋত্বিককেই বসানো যায়। সিনেমায়
মিউজিক যখন করেছেন সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়েই করেছেন। ‘চারুলতা’ এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
এবার একটা ক্লোজ শট নিয়ে বলবো। যেটা চারু যখন লিখতে মনস্থ করে তখনকার। এরকম
মারাত্মক ক্লোজ শট কোন ফিল্মমেকারের পক্ষেই বেশি সৃষ্টি করা সম্ভব না। সত্যজিতের কিছু
আছে। তার একটি এই চারুর মুখের সে সময়ের অভিব্যক্তি। এটা সেজানের উৎকৃষ্ট এক স্টিল
লাইফের সমতুল্য। অথবা রদাঁর ‘বালজাকে’র সঙ্গে তুলনা করা যায়। বালজাকের ভেতরটা
গড়েছিলেন অগুস্ত রদাঁ। সেটা সবার পক্ষে দেখতে পারা বা অনুভব করতে পারা সম্ভব ছিল না।
বলা যায় প্যারির পঁচা-গলা-বিষাক্ত বুর্জোয়া সমাজকে এঁকেছিলেন রদাঁ। সেটা সবাই দেখতে
পায়নি অথবা সহ্য করতে পারেনি। চারুর কষ্ট-যন্ত্রণা-নিঃসঙ্গতাবোধ অনুভব করতে পারাও কারো
পক্ষে সম্ভব ছিল না, এমন কি প্রিয় ঠাকুর পো অমলের পক্ষেও না। নিজের প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি
পত্রিকা SENTINNEL-র কাজে ব্যাস্ততা আর রাজনীতি নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকা স্বামী ভূপতির
পক্ষে চারুর নিঃসঙ্গতাকে উপশম করতে পারাটা রীতিমত অবাস্তবতা। অমলের সঙ্গে চারুর
সম্পর্কটা প্রথম থেকে স্বাভাবিকই মনে হবে। মানে বাঙালি পরিবারে বৌঠান-ঠাকুর পো সম্পর্কটা
যেমন হয় আর কি। কিন্তু শেষ অব্দি সম্পর্কটা তো আর সরলরৈখিক থাকেনি। তাহলে এই
সম্পর্কটার কী নাম দেয়া যায়? এটা দর্শকের ভাবনা-অনুভবের ব্যাপার। এই সম্পর্কটার নাম
আমরা প্রেম বা পরকীয়া যাই বলি এর যে ভয়ংকর অন্তর্ভেদী প্লাবন তার জেরে চারুর ভেতরকার
সাহিত্যিক প্রতিভা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অমলকে প্রাণপ্রিয় দাদা-বৌদির কাছ থেকে
পালিয়ে যেতে হয়। সত্যজিৎ এই সম্পর্কটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন, কখনও কখনও
গভীরভাবেই করেছেন, তো নাম দেননি। একান্ত নিজস্ব নিঃসঙ্গতার অধরে যখন কোন প্রিয়
মানুষের অনুভূতির ছোঁয়া লাগে তখন সেই ছোঁয়ার কী নাম দেওয়া যায়? প্রতিটি মানু্ষেরই নিজস্ব
এক জগৎ থাকে যেখানে অন্য কারো প্রবেশ অনেক দূরহ। তবে কারো কারো জগৎ অনেকটা
দুর্ভেদ্য প্রাচীরে আবদ্ধ। যেমনটা চারুর। বাল্যে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের স্নেহ-সাহচার্য পেয়েছিলেন।
আর এর প্রভাব পড়েছিল ওর সামগ্রিক কাজে। সত্যজিতের সিনেমায় যে মন তা রবীন্দ্রনাথের
মনের আবহে অনেকটা সঞ্চারিত, এটা বেশ অনুভব করা যায়। মানবমনের যে বিস্ময়কর চাওয়া-পাওয়া-অনুভব
তার প্রস্ফূটণ ‘চারুলতা’ আমাদের দেয়।
