একদিন স্কুল পালিয়ে
উপল বড়ুয়া
নন্তুরা আরেকটু সামনে এগোতেই হিসহিস করে কীসের যেন আওয়াজ শুনল।
চারদিকে রাবার গাছের ঝরাপাতা। পা পড়তেই মচমচে করে ভাঙছে।
পাতাকুড়ানির দল বোধহয় স্তুপ করে রেখেছে, সেই শুকনো পাতায় তারা
একটু লাফালাফিও করল। তবে সতর্ক হয়ে গেল হিসহিস শব্দ শুনেই। সাপ
নয়তো! হতে পারে। রাবার বাগানের অনেক ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছে নন্তু।
একবার দলবেধে শুকনো লাকড়ি কুড়াতে এসে এক বুড়ির খুব পিপাসা
পেয়েছিল। সে ভরদুপুরে ঝিরিতে নামে ঠাণ্ডা পানি খেতে। অনেক্ষণ ধরে
দলছুট বুড়িকে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে শুরু করে দলের বাকিরা।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখে, পেঁচিয়ে ধরে বুড়িকে এক অজগর গিলে
ফেলছে। তবে বুড়ি তার ধারালো দা উঁচু করে আছে। আর অজগর যতোই
গিলছে, তার পেটও চিড়ে যাচ্ছে। হিসহিস শব্দ শুনে নন্তুর সেই গল্পটা মনে
পড়ে গেল। তবে তারা একটু পর দেখে, হিসহিস করতে থাকা প্রাণীটি সাপ
নয়, হতভম্ব এক গিরগিটি। তাদের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে লেজ নেড়ে
আচমকা পাতার ওপর দ্রুত হেঁটে কোথায় হারিয়ে গেল। সাপ নয় দেখে
তাদের ভয় কেটে গেল বটে তবে একটু কথাকাটিও হলো তিনজনের মধ্যে।
নন্তু যদি বুড়ির গল্পটা না বলত তবে এখন মনটাও এমন ভার হতো না
সবার। গল্পটা বলতেই দীপন কথা কেড়ে নিয়ে জোর গলায় জানাল, ঘটনাটা
রাবার বাগানের নয়। বাঁশবাগানে বাঁশ কাটতে গিয়ে হয়েছিল। আর
অজগরের পেট কেটে বেরিয়ে আসা বুড়ো এখনো বেঁচে আছেন। দীপনের
কথায় সায় দিল সজলও। কথায় হেরে গেলে কার না রাগ হয়! নন্তুরও হলো।
সে বলল, এই গল্প সে শুনেছে তার দাদীর কাছে। দীপন মুখ ভেংচি দিয়ে
বলল, ‘তোর দাদী মিথ্যে বলেছে।’ এই গল্প সে শুনেছে তার পাড়ার এক
দাদুর কাছে। বাঁশ কাটতে যাওয়া দলে তিনিও ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে সে
আরও জানাল, তার দাদুরা বাঘের মাংস খেয়েছেন। এবার নন্তু হাসতে
হাসতে বলল, ‘ওরে মিথ্যাবাদী, বাঁশবাগানে বাঘ থাকে! বাঘ থাকে
সুন্দরবনে।’ দীপন আরও ক্ষেপে গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমি মিথ্যে বললে চল
দাদুর কাছে।’ সজল তাদের শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু দীপন কি আর
থামে! নন্তুও কম যায় না। একজন আরেকজনকে মিথ্যাবাদী, গাধা, ঘোড়া,
বানর, চোর ডেকেও ক্ষান্ত হলো না। মিথ্যাবাদী বা আর যাই হোক,
তিনজনই কিন্তু এক জায়গা একাট্টা। স্কুল পালানোয় সিদ্ধহস্ত। আহমেদ
স্যারের বেতের ভয়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে তারা এসেছে রাবার বাগানে ঘুরতে।
বুদ্ধিটা সজলের। প্রায় সময় তিনজনে কৌশল করে স্কুল পালায়। তার জন্য
ব্যাগে রাখে আলাদা এক সেট কাপড়। আর বইসুদ্ধ সেই ব্যাগ তিনটি রাখে
বিত্ত মামার পানের ছোট্ট দোকানে। বাথরুমে যাওয়ার নাম করে স্কুলের ডান
পাশের দেয়ালে লাগোয়া পেয়ারা গাছে চড়ে তারপর চার ফুট উঁচু দেয়াল
টপকে স্কুল পালায় তারা। যেখানে তারা লাফিয়ে পড়ে তার থেকে ডানে এক
মিনিটের কম লাগে হেঁটে বিত্ত মামার দোকানে যেতে। সেখানেই রাখে ব্যাগ।
স্কুলের প্রায় ছেলে এভাবেই স্কুল পালায়।
স্কুল তারা পালাত না। যদি আহমেদ স্যার গণিত ক্লাসে অমন রক্তাক্ত হয়ে
যাওয়ার মতোন না পেটাত। আজকেও সেই ভয়ে নন্তুরা একইভাবে স্কুল
পালিয়ে এসেছে রাবার বাগানে। এই বুদ্ধিটা সজলের। স্কুল পালিয়ে
কোথায় কোথায় যেতে হবে, সবকিছু আসে তার মাথা থেকে। নন্তু বাকি দুজনের
চেয়ে গণিতে ভালো। সে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু দুই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে
পালিয়ে এসেছে। এর আগে অনেকবার তারা স্কুল পালিয়ে রাংকূট, লম্বরী
পাড়ার বৌদ্ধ মন্দিরে বসে থেকেছে। বাঁকখালী নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে ঢুকে পড়েছে জঙ্গলে। রাংকূটের আশেপাশে জঙ্গল আর জঙ্গল।
অবশ্য খুব ঘন ও গহীন নয়। তারপরও নন্তু শুনেছে, রাতের বেলা সেই
জঙ্গলে বাঘ-ভাল্লুকেরও দেখা পাওয়া যায়। সাঁতার কেটে বাঘ পাড়ি দিত
বলেই নদীর নাম হয়েছে বাঁকখালী। মুখে মুখে ফেরা সেসব গল্পের সত্যমিথ্যে
সে জানে না। তবে মানুষের কথা সে বিশ্বাস করে।
রাবার বাগানের ভেতর তিন বন্ধু মিলে অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি করল। পাশে
আরেকটু এগোলেই চা বাগান। বাঁশবাগানটা আরেকটু সামনে। তারা হাঁটতে
হাঁটতে হাঁটতে চা বাগানে এসে থামল। দীপন তখন নন্তুকে বলে, ‘আমার
কথা যে বিশ্বাস করলি না, চল বাঁশ বাগানে ঘুরে আসি।’ নন্তুও একটু কৌতুক
করে বলল, ‘অজগরের পেটে যেতে ইচ্ছে হলে তুই যা, আমি নেই।’
ভরদুপুরে তারা অসংখ্য শালিকের ডাক শুনল। তাদের মাথার ওপরে ছায়া
হয়ে আছে একটি ঝুরি ছড়ানো বটগাছ। গ্রীষ্মে পাকা বটফল খেতে পাখিরা
দলবেঁধে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। সাধারণত বটগাছ চওড়া হয়। তবে এটি
বেশ লম্বা, তেমন চওড়া নয়। রাবার বাগানের ভেতরে ফাঁকে ফাঁকে বট,
গর্জনের দেখা মেলে। জাম গাছও চোখে পড়ল দুয়েকটা। দেখে চিনলেও
অনেক গাছের নাম তারা জানে না। তিন বন্ধু মিলে সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরল।
তারপর পাহাড় চিড়ে সর্পিল চলে যাওয়া রাস্তা পেরিয়ে তিনজনে চলে গেল
রেস্টহাউসের দিকে। ওখানটা গোছানো, সুন্দর। রাবার বাগানের মতো এমন
অসংখ্য এলোমেলো পথ আর গাছপালা নেই। তবে রেস্টহাউসের পেছনটায়
ঘন জঙ্গল। সেখানেই তারা বিকেল তিনটে পর্যন্ত বসে থাকবে। বিকেল
চারটায় স্কুল ছুটি। এক ঘণ্টার মধ্যে স্কুলের দিকে চলে এসে ইউনিফর্ম পরে
নেবে। এরপর ছুটির ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে বেরিয়ে আসা বাকি ছাত্রদের সঙ্গে
ভিড়ে মিশে বাড়ির পথে রওনা দেবে। কিন্তু তাদের এখন ঝামেলাটা
বাড়িয়েছে পেট ছোঁ ছোঁ করা খিদে। সেই সকালে খেয়েছে। এখন বাজে
১টা। কিন্তু কোনো দানাপানি পড়েনি পেটে। সজলের পকেটে ১০ টাকা আছে
বটে, সমস্যা হলো আশেপাশে কোনো খাবারের দোকান নেই। আর সজলও
জানাল, সারাদিন না খেয়ে থাকবে তারপরও টিফিন থেকে জমানো টাকা সে
খরচ করবে না। এই টাকা দিয়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের ফি দেবে সে। অবশেষে
সিদ্ধান্ত হলো, পাহাড় থেকে নিচে নেমে ঝিরির জল খেয়ে পিপাসা মেটানোর।
কিন্তু দীপন ভয় পেলো। কিছুক্ষণ আগে নন্তুকে বাঁশ বাগানে নিয়ে অজগরের
নিশ্বাসের ভয় দেখালেও এখন সে একই ভয়ে ঝিরিতে নামতে চায় না।
পাহাড়ের নিচের দিকে উঁচু হয়ে আছে কাঁটা ঝোপঝাড়। বিশেষ করে
লজ্জাবতী গাছ। নামতে গেলে পায়ে কাঁটা লাগবে। দীপন এসব অজুহাত তো দেখালোই,
তারপর বলল, ‘ঝিরির জলে জোঁকের বাচ্চা থাকে। আমি যাব
না।’ নন্তু ও সজলকে সাবধান করতে সে এক গল্পও ফাঁদল। তার কোন এক
আত্মীয় আলুটিলার ঝর্ণা দেখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত একটু পানি গিলে
ফেলেছিল। বাসায় ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেট ফুলে যায়। ডাক্তারের
কাছে নিয়ে গেলে জানা যায়, পেট ভর্তি জোঁক। সেই জোঁক রক্ত খেয়ে
একেকটা ঢোঁড়া সাপের মতোন ফুলে উঠেছে।’ সজল হেসে বলল, ‘ঝর্ণার
পানিতে জোঁক থাকে। ঝিরির পানিতে নয়।’ দীপন তো রেগে আগুন, ‘তুই
কিছুই জানিস না। পাহাড়ের ঘাম থেকেই ঝর্ণার পানি হয়। সেই পানিই
বয়ে বয়ে ঝিরিতে আসে।’
দীপন না গেলেও নন্তু ও সজল পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দিয়ে খাদের দিকে
নেমে গেল। যতোই নিচে নামতে লাগল ততোই তাদের গতি বেড়ে গেল।
ঝিরির পানি স্বচ্ছ ও ঠাণ্ডা। মনে হয় ফ্রিজ থেকে বের করা। পিপাসার্ত প্রাণীরা
যেভাবে পানি খায়, সেভাবেই মাথা নিচু করে দুজনে পানি খেল। সজল পানি
খেতে খেতে বাঘের মতো গর্জন করে উঠল, ‘হালুম’। নন্তু হয়ে গেল ঘোড়া।
পানি খেতে খেতে একটি হাত সে পেছনে নিয়ে লেজের মতো নাড়াতে
লাগল। দুজনে জলও ঘোলা করল। নন্তু বলে, ‘নামতে তো কষ্ট হয়নি, এখন
উঠতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’ সজল বুদ্ধি দিল, ‘চল আমরা লুকিয়ে পড়ি।
আমাদের না পেয়ে ভয়ে খুঁজতে খুঁজতে দীপনও নেমে আসবে। তখন
আমাদেরও কষ্ট করে উঠতে হবে না।’ হলোও তাই। মিনিট দশেক যাওয়ার
পর দীপন অনেক ডাকল নন্তু ও সজলকে। সে মনে করল, দুজনেই তাকে
ফেলে চলে গেছে। এমনিতে গ্রীষ্মের বন, হঠাৎ হঠাৎ বাতাস পাতায় পাতায়
বাড়ি খেয়ে এই নির্জন বনে ভীতি জাগানিয়া আওয়াজ তুলছে। খাড়া দাঁড়িয়ে
থাকা এক গর্জনের বাকলে ঠোকর মারতে মারতে কোনো কাঠঠুকরা হঠাৎ
হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠছে। সেই ডাক বুক হিম করে দেওয়ার মতোন। এমন
নির্জন বনে দীপন একা একা ভীষণ ভয় পেল। এখন যদি কোনো অজগর
এসে তাকে নিশ্বাস ফেলে গিলে ফেলে! অথবা হঠাৎ যদি একটা বাঘ এসে
তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে! রাবার বাগানের ডাকাতদের অনেক গল্পও শুনেছে
সে। যারা গুপ্তধনের সন্ধানে বাগানে ঘুরে বেড়ায় বন্দুক কাঁধে। এসব ভাবতে
ভাবতে সে একটু একটু করে খাদের দিকে নামতে নামতে নন্তু-সজল বলে
ডাকতে লাগল। বার কয়েক নিচের দিকে তাকিয়ে দুই বন্ধুকে খুঁজল। দীপন
ভয়ে আর না পেরে নিচে নামতে লাগল গতি বাড়িয়ে। আর অমনি তাকে
দেখে ‘হালুম’ বলে চিৎকার দিয়ে হাসতে হাসতে সজল ও নন্তু গড়িয়ে পড়ে
একে অন্যের গায়ে। দীপন তো ‘মাগো’ বলে পড়িমরি করে ছুট লাগায়! কিন্তু
পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে পড়ে থাকা রাবার গাছের মরা ডাল নিয়ে
দুজনকে দৌড়াতে থাকে।
