ক্যাফেইন
উপমা অধিকারী
১.
সেদিন আমাদের প্রথম দেখা। আমি বন্ধু ছিলাম নাকি প্রেমিক? কারোই জানা ছিলো না। দুজনেই সতর্কতার
সাথে প্রশ্নটা এড়ায় যাই। জেরিনের গায়ে ছিলো সবুজ রঙা লং ফ্রক, সেখানে সাদা বুটি বুটি ডিজাইন। উপরে
কালো জ্যাকেট। কেবল অল্প অল্প শীত পড়তেসে তখন। একটু পর পর বয়ে যাচ্ছিলো ঠান্ডা বাতাস। আমরা
বসছিলাম কফিশপের দোতালার জোনটায়।
আমি চলে আসছিলাম পয়তাল্লিশ মিনিট আগেই। মেন্যু কার্ডের সবচেয়ে কম দামি কফিটা নিয়ে চুপচাপ বসে
ছিলাম জোনে। একবার মনে হইলো, দৌড়ে পালায় যাই। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিয়ে নিচে তাকায় দেখি জেরিন;
রিকশা ভাড়া দিচ্ছে, আরেক হাতে অগোছালো করে ধরা কিছু সাদা ফুল। এরপর ও সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় চলে আসে।
আমি সিগারেট ধরাই।
সেদিন জেরিন অনেক কথা বলে ফেলে। একপর্যায়ে আমার লাল জ্যাকেটটারও প্রশংসা করে। অপ্রস্তুত হয়ে
যাই। প্রসঙ্গ এড়াইতে জেরিন জিজ্ঞেস করে আমাকে, কিছু খাবো কিনা। আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ বা না যে কোনো
কিছুই হইতে পারে সেটা। জেরিন নিচতলায় চলে যায়। আমাদের জন্য পেপার কাপে কফি নিয়ে আসে। আর দুইটা
রেড ভেলভেট কেক।
পরে অবশ্য জেরিন বলসিলো ওর রেড ভেলভেট কেক পছন্দ না। কিন্তু দেখতে রোমান্টিক, তাই কিনে ফেলসে।
সেই লাল রঙের সুন্দর কেকটা সামনে নিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। আমাদের টেবিলে তখন তিন কাপ
কফি, সবগুলাই ঠান্ডা হচ্ছিলো। আমার মনে হইতে থাকে, খাওয়া শেষ হলেই তো জেরিন চলে যাবে। আমি একটার
পর একটা সিগারেট ধরাই। জেরিনের দিকে প্যাকেট আগায় দেই। ও জানায় ও সিগারেট খায় না। আমি কৈফিয়ত
দিয়ে বলি, আমার ঠান্ডা কফিই পছন্দ। জেরিন জানায়, ওরও তাই।
সেদিন জেরিন আমাকে কাফকার গল্প শোনায়। বন্ধু ম্যাক্সকে কাফকা বলসিলো, মৃত্যুর পর ওর সব লেখা
পুড়ায় দিতে। ম্যাক্স সেই কথা রাখেনাই। জেরিনের কাফকা পছন্দ। এরপরেও জেরিন বলে, “পুড়ায় দিলেই ভালো
হইতো।” কথাগুলা নেহাত খেয়ালিপনাই লাগতেসিলো আমার কাছে।
আমি বরং দেখতেসিলাম বাতাসে জেরিনের উড়তে চুল। গায়ের জ্যাকেটটা শক্ত করে জড়ায়ে সামনে রাখা ঠান্ডা
কফিতে চুমুক দেয় ও। সেদিকে তাকায়ে আচমকা এক গভীর বিষাদে ডুবে যাই আমি। আমার মনে হইতে থাকে,
আমিও জানি, লেখাগুলো পুড়ায় দিলেই ভালো হইতো।
আমি তখনো কাফকা পড়িনাই। জেরিনের মুখে কাফকার নাম শুনে আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিলো মুরাকামির
কাফকা অন দ্যা শোরের কথা৷ এরপর মনে পড়ে যায় নরওয়েজিয়ান উডের কথা। ভাবতেসিলাম, জেরিন কি নাওকো
নাকি মিদোরি? নাওকোই হবে। এরপর আমার খারাপ লাগতে থাকে, কারণ নাওকো তো মারা যায়। আমি আমার
ব্যাগ থেকে নরওয়েজিয়ান উডের অনুবাদটা বের করি। বই পেয়ে জেরিন শিশুদের মতো খুশি হয়ে যায়। ওকে
মিদোরির মতো লাগে তখন। আমি ওর হাসি দেখি। গলার নিচে জামার ভাজে হালকা ফুটে উঠা ক্লিভেজ দেখি। মাথা
ঝিমঝিম করে ওঠে আমার। জেরিনকে বসায় রেখে নিচ তলায় চলে যাই আমি। এরপর হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখি
জেরিন ওর সাদা ফুলগুলো ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলতেসে। এরপর পাপড়িগুলো রেখে দিচ্ছে বইয়ের মাঝে। আমাকে
দেখে বলে, “চলেন একটু হেঁটে আসি।” আমি মাথা নাড়াই। জেরিনকে ওঠার জায়গা করে দেই। ও পিছন ফিরতেই
কফি টেবিল থেকে পেপার কাপ দুটো ব্যাগে ঢুকায় রাখি। এরপর পিছে পিছে নেমে আসি।
সেদিন আমরা অনেক্ষণ হাঁটি। কী এতো কথা বলতেসিলাম, মনে নাই। তবে আমি মাঝপথে বেকুবের মতো কিছু
একটা বলে জেরিনের মন খারাপ করায় দেই। এরপর ওর ক্লান্ত চোখের দিকে তাকায়ে আমার নিজেকে খুন করে
ফেলতে ইচ্ছা করে। জগতের সমস্ত ব্যর্থতার ভার বুকে নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, “শুক্রবার সময় হবে?”
জেরিন বলে, “হ্যাঁ।” আমার বুক থেকে পাথর নেমে যায়। আমি জেরিনকে বলি, “আমার একটা গল্প আছে। পরের
দিন নিয়ে আসবো। আমি মারা গেলে আপনি সেটা পুড়ায় দিয়েন।”
২.
আবারো জেগে গেছি।
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকি। মাথার যন্ত্রণাটা ফিরে ফিরে আসতেসে। আমি অস্থির হাতে বা
পাশের টেবিলটায় ফোন খুঁজতে থাকি। হাত লেগে কাচের গ্লাসটা পড়ে যায়। চাবির গোছা, কিছু ভেজা কাগজ সব
টান দিয়ে সরাইতে থাকি। ঐ তো ফোনটা, গ্লাসের চটচটে তরলটা স্ক্রিনে লেগে গেছে। সেটা তোশকে মুছে নিই।
এবার ফোনটা ঢুকায় নিই লেপের মাঝে। ভিতরে ভ্যাপসা গরম, চিরপরিচিত দুর্গন্ধ। আমি আমার ডান পা লেপের
বাইরে বের করে দিই। এবার চোখ খুলি। অন্ধকারে, ফোনের কটকটে আলো চোখে লাগে। চশমাটা কই রাখসিলাম
মনে করতে পারি না। আমি ফোনের ব্রাইটনেস ফুল করে দিই। এবার কল লগে গিয়ে কল দিই শেষ নাম্বারটায়।
ফোনে সেভ করা নাই, তবে নাম্বারটা আমার মুখস্ত। একটু পর ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘‘আপনি যে
নাম্বারে কল করেছেন, সেটি বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।’’
লেপের ভেতর থেকে হাত বাড়ায়ে ফোনটা টেবিলে রাখতে যাই। কীসের সাথে যেন বাড়ি লেগে সেটা নিচে পড়ে যায়।
আমি খোঁজার চেষ্টা করি না, লেপের তলায় ডুবে যাই আবারও। মশার কামড় খেয়ে পা ঢুকায় নিই ভিতরে।
জানলাগুলা বন্ধ করার দরকার। একটু পেচ্ছাবও করে আসা উচিত। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করতেসে না। আমি ডান
দিকে কাত হয়ে গুটিসুটি মেরে শুই। মাথার নিচ থেকে বালিশটা তুলে কানের উপর রাখি। দ্রুত ঘুমায় যাইতে হবে।
হাত কাঁপতেসে হালকা হালকা। আমি একটু গান গেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি। নিজের গায়ে-মাথায় হাত
বুলায় দিই, বুকের মাঝে দু’হাত জড়ায় নিই যাতে আর ফাঁকা ফাঁকা না লাগে।
বিছানা আকড়ে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় হাত-পা শান্ত হয়ে আসে আমার। বাম চোখ থেকে জল গড়ানোও
বন্ধ হইলো মনে হয়। বুকের শূন্য ভাবটাও মিশে যাচ্ছে। ঘুমায় যাচ্ছি আমি, আর চলে যাচ্ছি দূরে দূরে দূরে। এই
তো শান্তি। এখানেই শান্তি…
৩.
আমাদের আবারও দেখা হয়ে যায়। মেট্রো স্টেশনে, সন্ধ্যা নামে যখন। রৌদ্রর পরনে রঙ ওঠা ফ্যাকাশে লাল
জ্যাকেট, ডান হাতে পলিথিন আর বা হাতে একটা কাচাবাজারের ব্যাগ। পলিথিন ছিঁড়ে আঠালো কিছু একটা পড়ছে
মেঝেতে। আমি রৌদ্রের হাত থেকে পলিথিনটা নিয়ে ভালো করে বেঁধে নিই। এরপর হাঁটতে থাকি দুজনে। পথেই
সিদ্ধান্ত নিই, আবারও সব শুরু করবো, ঠিক প্রথমবারের মতো।
কফিশপটা আমার চিরপরিচিত। তবুও পৌঁছানোর পর থেকেই আমার নার্ভাস লাগতে থাকে। ঘড়ি দেখি, পয়তাল্লিশ
মিনিট আগেই চলে আসছি। একটা আমেরিকানো নিয়ে দোতালার জোনে এসে বসি আমি। একবার মনে হয়, কী
দরকার? উঠে একটা দৌড় দিই? পরক্ষণেই পেছন থেকে রৌদ্রের ডাক, “জেরিন…”
রৌদ্র চেয়ার টেনে বসে আমার মুখোমুখি। চুল এলোমেলো, পরনে সেই দশ বছর আগের লাল জ্যাকেটটা। আমার
মনে হতে থাকে, এটওই তো স্বাভাবিক, রেগুলার। মাঝের ঘটনাগুলো তো কখনোই ঘটেনাই।
শীত কেবল আসি আসি। ঠান্ডা বাতাসে রৌদ্রর চুল উড়ছে হালকা। ও ব্যাগ থেকে কিছু সাদা ফুল বের করে আমার
হাতে দেয়। দেখে মনে হয়, সেগুলো দশ বছর আগে কেনা আমার ফুলগুলোই। বইয়ের ভাঁজ থেকে আড়মোড়া ভেঙে
তাজা হয়ে উঠে আসলো এক্ষুণি। আর জেগে উঠেই ফুলগুলো এখন ঘটাচ্ছে টাইম ট্রাভেল। একটু একটু করে আমি
ফিরে যাচ্ছি অতীতে। এই তো দশ বছর আগের আমরা, কফি নিয়ে বসে আছি জোনে, আর রৌদ্র এখনি ব্যাগ
থেকে বের করবে নরওয়েজিয়ান উড। বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না সেখানে যদিও, পরমুহূর্তেই চলে গেলাম
আমার কৈশোরে। বিকালে এফএম রেডিও ছেড়ে দিয়ে বালামের গান শুনতে শুনতে যখন মনে হাহাকার জাগতো
আমার, ভাবতাম আমারও কি হবে এমন সুন্দর প্রেম? বাড়ি ফেরার পথে, সাইকেল থামায়ে গিটার বাজায়ে গান
গাবে কেউ… আমার জন্যে।
কৈশোরের সেই ফুরফুরে ভাবটা আমার সারা শরীরে পুলক লাগায়ে যায়। আমি গুনগুন করতে করতে একটা সিগারেট
ধরাই। রৌদ্রকে অফার করি। রৌদ্র জানায়, ও বিয়ের পর সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। আমার টাইম ট্রাভেল থেমে
যায়, আমি বর্তমানে ফিরে আসি। রৌদ্র জিজ্ঞেস করে, আমি কিছু খাবো কিনা। আমি মাথা নাড়ি। রৌদ্র
আমাদের জন্য আমেরিকানো আর দুইটা রেড ভেলভেট কেক নিয়ে আসে।
কেক আর কফি সামনে নিয়ে আমরা চুপচাপ বসে থাকি। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সঠিক
শব্দগুলো খুঁজে পাই না। প্যাকেটের সবগুলো সিগারেট শেষ হয়ে গেলে আমি কেক খাই। কফি শেষ করি এক চুমুকে।
আর তো কিছু করার নাই। আমি বাড়ি ফেরার কথা তুলি। রৌদ্র মনে হয় কিচ্ছুক্ষণ মনে মনে শব্দ গুছায় নেয়।
এরপর বলে, “চলো, তোমাকে সিগারেট কিনে দেই। আমিও খাবো।’’ এরপর আমার ঠোঁটের কোণে লাগা কেকের
টুকরো মুছে দেয় ও। হাত নামানোর সময় ছুঁয়ে যায় আমার চিবুক। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আমি রৌদ্রকে বলি,
“তোমার গল্পটা আমার কাছে এখনো আছে।” রৌদ্র উত্তর দেয়, “রেখে দাও না…”
৪.
‘‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন, সেটি বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।
ধন্যবাদ।’’
আমি ফোনটা টেবিলে রাখতে যাই, নিচে পড়ে যায়৷
সেইটা না তুলেই আমি লেপের ভিতর ডুব দিই। ঘুমায় যাইতে চেষ্টা করি। ঘুমায়ই পড়সি যখন শুনতে পাই বৃষ্টির
শব্দ। এবার লাফ দিয়ে উঠি আমি, বারান্দায় যাই। সেখানে আমার লাল জ্যাকেটটা রাখা, তাড়াতাড়ি তুলে আনি।
জানি, আবারও একদিন এই জ্যাকেট পরে বের হবো যখন, জেরিনের সাথে দেখা হয়ে যাবে আমার।
