মানিক কুমার
নাভিল মানদার
ঠিক ভোর ছ’টায় বিছানা থেকে হুড়মুড় করে উঠে পড়লো মানিক কুমার। মানিক কুমার
শিক্ষকতা করে শহরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেই যে মানিক যবে থেকে স্কুলের কাজ
শুরু করেছে তখন থেকেই সকালের ঘুমটা আজ অব্দি পরিপূর্ণ নিতে পারেনি। চোখ ডলতে
ডলতে অবিবাহিত মানিক কুমার মৃদুমনে ভাবে, উফ্ একটা বউ থাকলে ভালো হতো।
নিদেনপক্ষে সাত-সকালের চা-নাস্তাটা রেডি পেতাম।
মানিক কুমারের চেহারায় কেমন যেন ক্যাবলা ভাব আছে। ঠোঁটের উপর সর্বদা একটা হাবা-হাবা
হাসি ঝুলে থাকে কিন্তু সে যখন ইংরেজী ভাষায় কথা বলে তাকে একদোম অচেনা মানুষ মনে
হয়। প্রতিদিন কাঁটায় কাঁটায় আটটার সময় স্কুলে পৌঁছনো কী সম্ভব? আবার এক মিনিটও যদি
বিলম্ব হয় তবে শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। শাস্তিটা ঠিক শারীরিক নয়, বলা ভালো তা মানসিক
একইসাথে আর্থিকও বটে। এক মিনিট সমান এক টাকা— এরকম একটা অদ্ভুত ফর্মুলায় মূল
বেতন থেকে কেটে নেয়া হবে। ফলে যতো মিনিট বিলম্ব ততো টাকা কর্তন যাবে। মানিক কুমারের
রেকর্ড ভালো। আজ অব্দি এক মিনিটও লেট হয়নি।
তার শোবার ঘর এতোটাই সুন্দর, ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তেমন কিছুই না জাস্ট
আলো বাতাশের অবাধ যাতায়াত আছে। আর হাজার হাজার বই। এমনকি বালিশের পাশেও
নানা ধরনের বই স্তুপ হয়ে রয়েছে। একটা মাটির কলসও আছে। তার বিশ্বস্ত সাইকেলটি ঘরের
ভেতর এমনভাবে মানিয়ে যায় মনে হবে ঘরেরই কোনো আসবাবপত্র।
বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সে দাঁত ব্রাশ শুরু করে। আর কল্পনা করার উদ্যোগ নেয় কেমন
করে স্কুলে সময়মতো পৌঁছতে হবে। সহকর্মীদের কুশল বিনিময়ের উত্তরে সৌজন্যতা রক্ষা
করতে হবে। বছর বছর একই বিষয় স্টুডেন্টদের পড়াতে হবে। সে আরো কল্পনা করার উদ্যোগ
নেয় কেমন করে ঘরে ফিরে কেবলি বই পড়বে আর ইচ্ছে মতো বাইরে বেরিয়ে পড়বে যত্রতত্র।
শিগগিরই সে গান শোনার জন্য একটি রেকর্ড প্লেয়ার কিনতে চায়। নিজের মোবাইলে গান হয়
বটে কিন্তু তাতে ঠিক তার পোষায় না। সে একথা জানে গান হলো এমন একটি অনুভব যা নলেজ
দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। তার মনে পড়ে যায়, বাবার মুখে কোনোদিন গান গাইতে শোনেনি। মা
ছিলো তেমনি সুন্দর আর গলাটাও ছিলো ভারী মিষ্টি। মায়ের গান শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়তো।
সাইকেলে চেপে স্কুলে পৌঁছতে মিনিট ত্রিশেক সময় লাগে। অনেকবার ভাবনায় এসেছে স্কুলের
আশপাশে একটা ঘর ভাড়া করা যায় কিনা। কিন্তু নিজের ঘরের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি।
তাছাড়া সাইকেল চালানো মানিক দারুণ উপভোগ করে। সাইকেলের চাকা যখন ঘোরে মানিকের
ভাবনারাও ঘুরে ঘুরে প্রদক্ষিণ করে। চাকা এমন একটি সৌরজগত যেখানে দিন রাত উৎপাদিত হয়।
রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য অবিরাম দৌঁড়চ্ছে। মানিকও এগিয়ে যাচ্ছে। এই সকালের শহর চোখের
দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে যেন বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা অট্টহাসিতে পরিণত হবে। হঠাৎ
করেই দুর্ভাগ্য, ঠিক স্কুলের গেটে পৌঁছনো মাত্র সাইকেলের হাওয়া চলে গেলো। ভিতরে ভিতরে
সাইকেলটিও হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো। টায়ার ফাটিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তড়িঘড়ি করে
নেমে পড়লো মানিক। কী আর করা, অগত্যা ঠেলতে ঠেলতে তাকে হাটতে হলো মাঠ পেরিয়ে
স্কুলের বারান্দা অব্দি। এই প্রথম আজ তার এক মিনিট বিলম্ব হলো।
এই প্রথম সে মাস শেষে এক টাকা কমে বেতন উত্তোলন করবে। যেহেতু এক মিনিট লেট। এবঙ
অবাক ব্যাপার, আজ সকাল আটটার স্কুলে পৌঁছতে শেষমেশ বিলম্ব হওয়ার জন্যে তীব্র আনন্দ
অনুভব করলো। মানিক কুমার এই ভেবে ভেবে পুলকিত হলো,— সামনের মাস থেকে আরো
আরো আনন্দ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
