অণুগল্প
রাজনীতি
ঘুম থেকে উঠে মিনিট দশেক হাঁটাও হলো, অথচ কেমন যেন লাগছে। হালকা লাগছে, কি যেন নেই কি যেন নেই
একটা ভাব।
তারপর হঠাৎই আবিষ্কার করে বসলো আসল ঘটনা। নেই, সত্যি সত্যিই নেই!
প্রিয় লেজটা! আহা! নেই!
টিকটিকিটি বিশ্বাসই করতে পারছে না তার ফর্সা, প্রায় ছাইরঙের লেজটি আর নেই। ঘুমের মধ্যে চুরি হয়ে
গেছে।
হারানো লেজের দুঃখ নিয়েই সে ফিরোজা রঙের গোটা দেয়ালটি এক দৌড়ে পার হয়ে যায়। সিলিংয়ে হাঁটে, দরজা
ও জানালার কবাট ধরে ছোটাছুটি করে।
এটা তৃতীয় দিনের ঘটনা। আগের দুদিনে আরো আটজন টিকটিকির লেজ চুরি হয়েছে। বিষয়টা উদ্বেগের।
অসম্মানেরও। নিজের লেজটিকে সামালে রাখতে না পারাটা নিশচয়ই সম্মানের নয়!
নিজের লেজই যার চুরি হয়ে যায় সে কি করে বউ-বাচ্চার দেখভাল করবে! ওয়াক থু! বউ চলে যায় কারো
কারো।
কাপুরুষ কোথাকার! লেজ ছাড়া সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করে না? প্রেমিকা চলে যায় কারো কারো।
লেজ নাই পণ্ডিত…হাহাহা। কাউকে কাউকে সইতে হয় বিস্তর উপহাস।
অষ্টম দিনের গল্পটা ভিন্ন। গোটা টিকটিকি সমাজেরই মাথা হেট। ঘুমের মধ্যে লেজ চুরি গেছে সকলের।
নবম দিনে তারা গেল মাকড়সার কাছে। মহান মাকড়সা, যিনি জাল পেতে পোকা ধরেন। সেইসব পোকার
একটা অংশ যায় টিকিটিকির পেটে। মাকড়সা বুদ্ধিমান, হাজার বছর ধরে টিকটিকি সমাজ ভরসা করে এসেছে
তার ওপর।
সবিস্তারে ঘটনা শুনে মাকড়সা অবাক।
শোন ভাইয়েরা, লেজ হয়তো আবার গজাবে, কিন্তু হারানো সম্মান আর ফিরে আসবে না। এখন থেকে সতর্ক
থাকো, যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় আর। যতদিনে না চোর ধরা পরে ততদিনে আমি দুচোখের পাতা এক
করবো না। নিশ্চিন্তে ঘুমাও তোমরা। মাকড়সা বললো।
ধন্য ধন্য রব উঠলো, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এলো টিকটিকি সমাজের। চিরকৃতজ্ঞ তারা।
তবু, সন্দেহবাতিকগ্রস্থ কারো কারো মনে হতে লাগলো খুব বড় একটা মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে তারা।
লাউডস্পিকার
তার ধারনা মৃতেরা তার কথা শুনতে পায়।
তাই সকাল আর সন্ধ্যা নেই, তৈয়বুরকে পাওয়া যাবে গোরস্থানে—একদম উলঙ্গ হয়ে ভাষন দিচ্ছে কবরবাসীর
উদ্দেশ্যে।
“ভাইয়েরা আমার, রাজপথ আজও চিত হয়ে শুয়ে আছে বাধ্য স্ত্রীর মতো, শুধু একবার বীরের মতো ঝাপিয়ে
পড়ো, সঙ্গমের ভঙ্গিতে কাঁপিয়ে দাও পূঁজিবাদের ইশতেহার। অবশ্যই তোমার কোলে জন্ম নেবে শিশু বিপ্লব…”।
তৈয়বুর ভাষন দেয়, মৃতেরা জাগে না, শুধু মুগ্ধ হয়ে শোনে।
তৈয়বুর সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতো। ছাত্রজীবন থেকে লড়াকু ছেলেটি হারাতে হারাতে সবই হারালো, এমনকি
পোষাকও।
যেবছর লোনের টাকা নিয়ে এনজিওওয়ালাদের সাথে ঝামেলা হলো, শেষপর্যন্ত ঘটনা গিয়ে জেলখানা পর্যন্ত
গড়ালো সেই বছরেই গেল মাথাটাও।
কদবেলের মতো ফাঁকা ও ফাঁপা মাথাটি দিয়ে ভেবেই শেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসবের পেছনে পূঁজিবাদই দায়ী!
জীবিত মানুষগুলো এসব বাক্-বক্তৃতায় বিশ্বাস করে না। মৃতেরা বিশ্বাস না করলেও অবিশ্বাস যে করে তাও তো
বলেনি কোনদিন! তাই কবরখানায়ই বিপ্লবের কারখানা খুলেছে তৈয়ব।
“তোমার শরীরে শুধু পঁচা মাংসের গন্ধ…” ভয়ে ভয়ে বলেছিলো রোখসানা, শেষ সঙ্গমের দিনে। তৈয়ব
বুঝেছিলো, প্রেমিকার কাছেও সে এখন মৃত একজন।
মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন, আর যায়নি।
সন্ধ্যা হলে হরর ফিল্ম ভর করে তৈয়বের দেহে। মনে হয় মৃতেরা তাদের দল ভারী করতে চায়। তৈয়বুর তাই
রাত হবার আগেই জীবিতদের শহরে আশ্রয় নেয় প্রতিদিন।
রাস্তার পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে সে, এভাবে অন্ধকারের ভয়ে গুটিয়ে গেলে বিপ্লব কি করে আসবে! দিন-
রাত সমানতালে না খাটলে দীর্ঘায়িত হবে বিপ্লবের পথ। আরো দেরি হয়ে যাবে পূঁজিবাদের হাত থেকে নিজের
মস্তিষ্ক উদ্ধার করতে।
ভাবতে ভাবতেই তৈয়বুর দৌড় লাগায় গোরস্থানের দিকে। রাতের পুলিশ টর্চের আলোয় উলঙ্গ বিপ্লবীর থলথলে
পাছার দিকে তাকিয়ে ফেটে পড়ে অট্টহাসিতে।
দণ্ড
একাধিক টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্র থেকে সাংবাদিক এসে কতগুলো ভুলভাল তথ্য নিয়ে চলে গেল।
আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, যদিও আমি নিশ্চিত অন্যান্যদের ভুলভাল বক্তব্যের পাশে আমার কথাগুলোও
তাচ্ছিল্যভরে প্রকাশ করবে এরা।
সাংবদিকরা যখন তাদের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন গোছাচ্ছিলেন, তখন আমাকেও পিছমোরা করে বেঁধে
পুলিশের ভ্যানে তোলা হচ্ছিল। ভ্যানের মধ্যে চারজন পুলিশ এবং আমি ছাড়াও আরো একজন রয়েছেন, মৃত।
তার নাম শাহানা আক্তার, পোস্টমর্টেমে যাচ্ছে।
অন্যদের দেয়া সেইসব ভুলভাল তথ্যকে কেন্দ্র করে আদালতও বছর দেড়েক নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরলো। তারপর
সেপ্টেম্বরের একটি সুন্দর রবিবার দেখে আমাকে শুনিয়ে দিলো ফাঁসির দণ্ডাদেশ। ভাল। কিন্তু একটাই দুঃখ,
আমার পক্ষে যিনি কথা বলতে পারতেন, সেই শাহানা আক্তার এখন আর পৃথিবীতে নেই।
ফাঁসির কয়েক ঘন্টা আগে জেলার এসে বললেন, তোমার শেষ ইচ্ছা বলো।
আমার কোন শেষ ইচ্ছে ছিলো না। আমি আবারও ভাবলাম। সত্যিই কি আমার কোন ইচ্ছে নেই!
আমার ভেতর থেকে কে যেন বললো, আমাকে কেন ফাঁসি দেয়া হচ্ছে জানতে ইচ্ছে করছে খুব।
ছোট শহরের বড় গল্প
ত্রিশ বছর একসাথে বসবাসের পর পরস্পরের প্রতি যতটূকু মায়া জন্মানো উচিত, তারও বেশি মায়ার জালে
বাঁধা পড়েছি আমরা।
জানালা
আমাকে তুলনা করা হয় প্রজাপতির সাথে, কেননা তার ডানার আদলে আমাকে দেয়া হয় দুটো কবাট, খুলে
দিলেই হুহু করে হাওয়া ঢোকে, স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাস্তার দৃশ্য।
আমি দুঃখিত এবং আতঙ্কিত। এই ঘটনার জন্য আমি নিজেকেই দায়ী করবো, কেননা তস্কর লোকটি এই পথেই
ঘরে প্রবেশ করেছিলো।
ওয়ার্ডরোব
বিগত এক যুগ ধরে আমার বুকে যতটুকু শূন্যতা তার সবটুকু তুলে দিয়েছিলাম তার হাতে। কতগুলো শাড়ি,
ম্যাক্সি, নাইটগাউন, ব্রা ও প্যান্টি পাহারা দিয়েছি তার কোন গোনাগুনতি নেই। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, তার
গোপন যত প্রেমপত্র তাও কিন্তু আমার কাছে গচ্ছিত আছে এখনও।
আমি দুঃখিত—ভালবাসার মানুষটিকে বুক পেতে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না।
খাট
তাকে আমি পেটে ধরিনি সত্য, কিন্তু আমার সন্তান বলতে সে একাই। যখন সে কাঁদতো, তখন তাকে বুকের
মধ্যে জড়িয়ে ধরাটাই একমাত্র কাজ ছিলো আমার। সে যখন চিৎ হতো, উবু হতো—সর্বাবস্থায়ই সে আমার
মেয়ে, আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘুম পাড়াতাম। বালিশগুলোকে সাক্ষী মানুন, সত্য উঠে আসবে।
সিন্দুক
পাঁচ পাই, দশ পাই থেকে চার আনা-আট আনা পর্যন্ত আমাকে চেনে। একশ দুশো হাজার টাকার নোট আর
গহনাগাটি আমার কাছে গচ্ছিত রেখে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চলে যেত সে। আফসোস—সে নিজে কেন আমার
কাছে আশ্রয় চায়নি কোনদিন!
টেলিফোন
যাবতীয় গোপন কথা আমি পৌছে দিয়েছি ওপাড়ে, নিজস্ব মানুষের কাছে। শুধু তার শেষ চিৎকারটি আমার
গলার কাছে আটকে আছে, সরছে না।
ছুরি
তার হাতটি যথার্থ কোমল, আঙুলগুলো সরু। যখন সে আমাকে মুঠো করে ধরতো, ভাললাগায় তিরতির,িয়ে
কেঁপে উঠতাম আমি। তখন—আপেলগুলোকে মনে হতো মাখন, অবলীলায় কেটে দুভাগ করে দিতাম।
পৃথিবীতে আমার চেয়ে অভাগা কেউ নেই। তার পেটের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উন্মাদ হয়ে উঠলাম আমি। অথচ
পৃথিবীতে ছুরিদের জন্য কোন উন্মাদআশ্রম নেই।
অভিশাপ দিচ্ছি আমি, লোকটির শক্ত-খসখসে হাতটি ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক নিজেও।
মেঝে
চোখ বন্ধ করুন। এবার ভাবুন যে, আপনার কোলে আপনার প্রেমিকার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে তিনদিন ধরে।
লাশে পঁচন ধরেছে, অথচ আপনি তার সৎকার করতে পারছেন না। এবার বলুন, আমার চেয়ে দূর্ভাগা কারো
খোঁজ কি জানা আছে আপনার?
আমি কাঁদছি, তুমুল বিষণ্ন সুর নিয়ে। অথচ মাথার ভেতরে বাঁজছে একটি শিশুর পায়ে নুপূরের শব্দ, এবং তার
বড় হয়ে ওঠা। ত্রিশ বছরের পদশব্দ কান্নার সাথে কেমন বেসুরো বাজনার মতো বাজছে!
দরজা
এই খুনের জন্য আমাকে গ্রেফতার করা হোক, কেননা খুনিকে আমিই বাইরে যেতে সাহায্য করেছি। প্রিয়জন চলে
যাবার পর এভাবে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে নেই।