কবিতা
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
পাতাঝরা দিনের মতো এইসব অস্থিরতা
গভীর আঁধার থেকে উঠে আসি— ঘুম থেকে জাগরণের মতো— কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকি
তোমার দিকে দ্যাখি, কে যেন আমার শরীরে হেঁটে বেড়ায়— অন্ধকার থেকে আলোর উৎসমুখে,
যেন এক দীর্ঘ যাত্রা। এ’যাত্রা শেষ হয় না মেহেরুন! শহরে এখন মোমবাতির আলোর মতো— বিচ্ছিন্নতা।
চোখ বন্ধ করতেও ভয় হয়। আমি মুখের দিকে দ্যাখি— সবগুলো একই মুখ—হাসছে, কাসছে— থু করে ছিটিয়ে
দ্যায় থু থু। চায়ে চুমুক দ্যায়-ধোঁয়া টানতে টানতে— ঝাঁকুনি দিয়ে ছাই ফেলে। হোটেল ব্যবসায়ীরা মিটিং
করে, বাজার কমিটি মিটিং করে, রাষ্ট্রপক্ষ মিটিং করে, জাতিসংঘ মিটিং করে— কোথাও নেই একটু স্থিরতা।
আমার কেবল স্থির জলে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।
দীর্ঘ শ্বাস নিই। এইসব পাতা পুড়ে যাওয়া দিনে জলের বড় হাহাকার। আরশোলাদের মতো দিকে দিকে ছুটি।
মানুষের চিৎকার শুনি— খিস্তি-খেউড়—রাজা-উজির মেরে ফেলার গল্প। আমার কেবল শোকের মতো হাসি
পায়। টিভি নিউজ দ্যাখি— বিবিসি, সিএনএন, সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল: মাংস পুড়ে যাবার গন্ধ পাই। গণ
কবরের মতো অশ্লীল মনে হয় সবকিছু!
পাহাড়ের মতো চুপ
মাঝে মাঝে পুরো রাষ্ট্র পাহাড়ের মতো চুপ হয়ে যায়। সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসে নির্বিচারী হাওয়া।
মানুষের কান্নার মতো মনে হয়- শব্দের আনাগোনা। শীতল রক্তের শরীর সরীসৃপের মতো মাথা তুলে ক্রমেই
নুইয়ে যায়-যেন শুধু দেখবার দায় ছিলো। আরো কতো খবর আসে, মৃত্যু ও মগজের খবর,রক্ত ঝরে পড়ার
খবর-দেহ পীড়ণের উল্লাস ধ্বণি।
আমরা পাহাড়ের মতো চুপ, গভীর উদাসী ভঙ্গিতে।
আমাদের মগজে তবুও খেলে না যথার্থ বিদ্যুৎ সঙকেত। এপার থেকে ওপারে চলে যায় বিষণ্ণ পাখির দল।
মুদ্রার মতো হাত বদলে যায় সকল-বোধ ও বুদ্ধের বাণী। এত এত- ক্লান্তির ভোর আসে, চলে যায়
নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে। তারো আগে বহুল শরীরের গান শুনিয়ে ওরা হেঁটে গিয়েছিলো-অনির্দিষ্ট নামে।
আমরা পাহাড়ের মতো চুপ, গভীর উদাসী ভঙ্গিতে।
না হয় তোমাকে চেয়ে
১.
না হয় তোমাকে চেয়ে—নিঃসঙ্গ শরীর বুনেছি
শীতনিদ্রায় যেনবা কটিয়েছি আঁধার দুপুর
দুরের নক্ষত্র তুমি—ক্রমে ক্রমে এ’সত্য জেনেছি
বিরহ রেখায় তুমি চলে যাবে দূর—বহুদূর
এখানে মেঘেরা জমে, জল জমে ঘাসের উপর
উদ্বাস্তু হাওয়া আসে, আসে অলৌকিক কোন গান
কোন একদিন যদি জুটে যায় কিছু অবসর
নিস্তরঙ্গ জীবনের কাছে তুলে রাখা অভিমান—
ভুলে যাবো—দূর কোন যাত্রায় শিউলি ঝরা মায়া
তার চোখের ভাষায়, যা কিছু স্পর্শের জন্য নয়
হৃদয়ে আকুল গান, কিছু অচেনা ব্যথার ছায়া
প্রতিজীবনের কাছে জড়াবে কে কা’র পরিচয়?
২.
তবুও আকুল গান ছুটে আসে সুরের ভাষায়,
কোনো এক দূর কণ্ঠ যেন ডাকে—হৃদয় জাগায়
বিহঙ্গের সেই ডাক তার নিজেরই অন্তর্গত,
স্পর্শের ওপারে যেন—অনুভবে থাকে এ’জগৎ
বৃষ্টি নামে—পৃথিবীর কান্নার মতো, আকাশ সিক্ত
চির প্লাবনে যেনবা ক্রমে ক্রমে হয় প্রকাশিত
জানি এ’জল কখনো ছোঁয়া যায় না ব্যাকুল হাতে
শুধু গল্পগুলো থাকে—গভীর অলকের সম্পাতে
তবু হৃদয় বোঝে না—ছুঁয়ে দেখতে চায় যে সব
যে আকাশ মেঘে ঢাকে, ফুরায় না এই অনুভব
তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে, এক অদ্ভূত মায়ার পাশে—
বৃষ্টি-মেঘ-হৃদয়ের গৌরব নিয়ত ভালোবেসে।
৩.
দুপুরের মেঘলা আলো—
মাটির বুক ছুঁয়ে আসে নীরব বৃষ্টির গন্ধ,
সে যেন অন্য কোথাও—থাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে—
চোখের গভীরে এক নদী
কে তবে হৃদয়ের ভাষা বোঝে
বাতাসে ছড়িয়ে যায় ভেজা পাতার শব্দ
প্রেম তবু ছড়িয়েছে কেমন আকুল করা সুর
—অদেখা রঙের মতো
শুধু এই নীরব দুপুরের বুকে,
তোমাকে অনুভব করতে চাই—
যেমন বৃষ্টি মাটিকে জড়িয়ে ধরে,
যেমন বাতাস হঠাৎ ছুঁয়ে যায় ডালপালা
আর হৃদয় বোঝে—
এই প্রেম তারই মতো একা
যেমন আকাশের বৃষ্টি
কেউ তাকে ধরে রাখতে জানে না
যেমন হাঁসেরা ঘাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকে
তবু জানে না—
যে জলাধারের গল্প বয়ে বেড়ায়,
তা কখনোই পাওয়া হয় না…
৪.
সবকিছু ভেঙে পড়ে, আর কিছু রাত্রির প্রমাদ
আমাকে আলাদা করে যেভাবে সকাল থেকে রাত—
আলাদা হয় নিয়ত গ্রহ ও নক্ষত্রের পর্যটনে
চারিদিকে শুধু তার গ্রহণের চিহ্ন পড়ে আছে
শুনেছি প্রবাসী নাম, তুমি কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছো
প্রতি বিকেলের ছায়া সন্ধ্যার গানে মিলিয়ে যায়
কত স্বর ভেসে আসে, আমার স্মৃতিতে কেউ নেই
আছে এক বিকেলের ছবি যেদিন কেঁদে উঠেছো
অথচ পাহাড়সারি—দু’দিকে অনাহূত লোকেরা
তোমাকে নিয়েছে চলে, কোনো এক নিজস্ব নির্জনে
আমিও ছিলাম দূরে, খেই হারা পথিকের মতো
না বুঝার ভীড়ে তুমি যেনবা কিছুটা ইতস্তত
কারো কণ্ঠে বেজে ওঠে গান, ছুঁয়ে সম্পূর্ণ তোমাকে
জানি এ’কণ্ঠের ভার—তুমি কেন চাওনি আমাকে।
